হ্যাঁ। মন্ত্রীর গাড়িতে গ্রেনেড ছুড়েছে আরিফ। এমন দিনদুপুরে অপারেশন করে খুব সাহস দেখিয়েছে ওরা। নিরাপদে যেতে পেরেছে এটাও খুশির খবর।
শোকর আলহামদুলিল্লাহ। আমার ছেলে কোথায় আছে খবর পেয়েছ? গত দশ দিনে ওর কোনো খবর পাইনি।
শুনেছি ও ফার্মগেটের বাড়িতে আছে। এখনো আছে কি না, তা তো জানি না।
যাক, ভালো থাকুক। ও একটা ফোন করলে পারত।
ওই বাড়িতে ফোন নেই। তা ছাড়া সব সময় ওর খবর পাব, এমন আশা না করাই ভালো বোধ হয়। কত দিকে কত জায়গায় থাকছে, তার কি ঠিক আছে!
মন বলে যে জিনিসটি আছে, সেটা সব সময় যুক্তি মানে না। আয়শার ভেজা কণ্ঠস্বর আবার ঘরে ছড়ায়। সে কণ্ঠস্বর আকমল হোসেনের বুকে বেঁধে।
মন খারাপ করলে? আকমল হোসেন অপরাধীর ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেন।
একটু তো খারাপ হয়েছেই। এমন করে বললে, যেন এ সময় আমি বুঝি বা ছেলের চলাচল আমি নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছি।
সরি, আশা। আমি এতটা বোঝাতে চাইনি। তোমার ভাবনা ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছি। হয়তো বলাটা ঠিক হয়নি।
এসো। বুঝেছি, আর বলতে হবে না।
আয়শা মৃদু হেসে আকমল হোসেনের হাত ধরেন। দুজনে পেছনের বারান্দায় এসে বসেন। ঝোপঝাপের জোনাকি দেখেন। আয়শা বলেন, আজকের ঘটনাগুলো খুবই আকস্মিক।
যুদ্ধের সময় কোনো কিছু আকস্মিক থাকে না, আশা। সবটাই প্রস্তুতির ঘটনা। প্রতিটি ঘটনার ভেতরে গভীর অর্থ আছে। তা আমাদের বুঝে নিতে হবে। আমি যে সময়ের ইতিহাস লেখার উপকরণ সংগ্রহ করে যাচ্ছি, এসব সে ইতিহাসের বড় তথ্য। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এই ইতিহাসের উপকরণ।
হয়তো তা-ই। এত কষ্টের অভিজ্ঞতার ইতিহাস কি পৌঁছাবে স্বাধীন দেশের মানুষের কাছে?
আয়শা দীর্ঘশ্বাস ফেললে আকমল হোসেন আয়শার মাথা নিজের ঘাড়ের ওপর রাখেন। হাত দিয়ে জড়িয়ে রাখেন তাঁকে। আয়শা, আমরা একসঙ্গে এই বাড়িতে স্বাধীনতার পতাকা ওড়াব।
সেই রাতের শেষ প্রহরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছের একটি দুর্গবাড়িতে ঢোকে পাকিস্তান আর্মি। এই বাড়ির পেছনে কাঁঠালগাছের নিচে গর্ত করে হাউস বানিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখা হয়েছে।
ওরা প্রথমেই প্রত্যেককে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে, আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়?
আমি। তিনি সামনে এগিয়ে যান।
সেনা অফিসারদের একজন রাইফেলের বাঁট দিয়ে ভীষণ জোরে তার বুকে আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠে আসে।
এরপর হুকুম দেয়, যেখানে অস্ত্র রাখা আছে, সেটা খুঁড়ে অস্ত্র বের করতে। মাত্র দিন কয়েক আগে আরও দুই বাক্স অস্ত্র আনা হয়েছিল। আলতাফ মাহমুদ তার কালো রঙের অস্টিন কেমব্রিজে করে গোলাবারুদ নিয়ে আসেন তার বাড়িতে। একটি টিনের বাক্সে ভরা ছিল সেগুলো। বাড়ির চারজন মুক্তিযোদ্ধা অনেক রাত পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে অস্ত্রের বাক্স রেখে তার ওপর ইট-বালু দিয়ে ঢেকে রেখেছিল।
আগস্ট মাসে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির ভারত সফর করার কথা ছিল শরণার্থী শিবির দেখার জন্য। পাকিস্তান সরকার চেয়েছিল, তাকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখাবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কেনেডির অবস্থান দেখে তারা সে আমন্ত্রণ বাতিল করে। কেনেডি কলকাতা থেকে ফিরে যান। ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকার কথা ছিল কেনেডির। ইন্টারকন্টিনেন্টালে বোমা ফাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্যোগ নিয়েছিল জানান দিতে যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। শহরজুড়ে আমরা আছি।
গেরিলাদের বড়সড় আক্রমণের জন্য গোলাবারুদ জোগাড় করা হয়েছিল অনেক। পরিকল্পনামতো কাজ না হওয়ায় অল্প বারুদ দিয়ে বোমা ফাটানো হলো ঠিকই, রয়ে গেল অনেক। সেগুলো রাখার জন্য নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন আলতাফ মাহমুদ।
যমদূতের মতো এসে দাঁড়াল ইবলিসরা।
ওদের দিয়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ তুলিয়ে গাড়িতে ওঠানো হলো। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে ওঠানো হলো বাড়ির সব কয়জন গেরিলাযোদ্ধাকে। আলতাফ মাহমুদের বুকে-মুখে তখনো রক্তের দাগ।
গাড়ি যখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়, তখন দিনের আলো শুরু হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া তেমন নেই। প্রচুর কাক উড়ছে শহরের ওপর দিয়ে। পুব আকাশে সূর্য লাল হয়ে বেরিয়ে আসছে। গাড়ি ছুটছে তেজগাঁওয়ের এমপি হোস্টেলের দিকে। সেটি এখন একটি বন্দিশিবিরে পরিণত হয়েছে। ওদের সেই বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হলো।
রাতে প্রায় নির্মুম কাটিয়েছেন আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন। বারান্দায় আসতেই দেখলেন সিঁড়ির ওপর মেরিনা বসে আছে।
কিরে, তুই এত ভোরে?
ঘুম আসছিল না, মা। বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ বোধ হয় গেটে ধাক্কা দিচ্ছে। আমার মনে হয়েছিল, মাঝেমধ্যে গোলাবারুদ রাখার জন্য যারা আসে, তাদের কেউ হবে। তাই উঠে পড়েছি। দেখছি কোথাও কেউ নেই। বাইরে এসে দেখি, আলতাফ ভাইও ঘাসের ওপর বসে আছেন।
আমিও ঘুমোতে পারিনি। কেমন জানি লাগছিল, বলতে পারব না। অন্য সময় ভোররাতের দিকে ঘুম আসে। কালকে তা-ও হয়নি। আমি তো সেই ভোররাত থেকে উঠে বসে আছি। রাস্তাটা এমন ফাঁকা। গেট খুলে বাইরে এসে বুক খা খা করছিল। ভয়ে আবার গেটের ভেতরে ঢুকে পড়ি।
আলতাফ থামতেই আকমল হোসেন এবং আয়শা খাতুনের দৃষ্টি মন্টুর মায়ের ওপর পড়ে। ও বারান্দার এক কোনায় গুটিসুটি শুয়েছিল। আলতাফের কথা শুনে উঠে বসেছে।
মেরিনা বলে, আমি ঘুম থেকে উঠে বুয়াকে বারান্দার কোনায় শুয়ে থাকতে দেখেছি। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? বলল, ভোররাত থেকে শরীর খারাপ লাগছে। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে। আমি বললাম, নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকেন। আমাকে বলল, ঘরে ভালো লাগছে না। মনে হয়, দম আটকে আসছে।