ব্যারাকের দেয়ালের পাশের চালতাগাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ওকে। ছোট গাছ বলে ওর উল্টে থাকা হাতের আঙুল মাটি ছুঁয়ে থাকে। লম্বা চুলের গোছা মাটি ছুঁই-ছুঁই করে। যেহেতু রাবেয়ার জ্ঞান নেই, সেহেতু ও তাকাতে পারছে না এবং দেখতে পারছে না যে চালতার সুন্দর সাদা ফুলটি ওর হাতের কাছে ঝরে পড়েছে।
সন্ধ্যা নামে।
পরদেশী এসে দাঁড়ায় আকমল হোসেনের বাড়ির গেটে। দরজা খুলে দেয় আলতাফ। ওকে কাঁদতে দেখে বুঝে যায় কিছু একটা ঘটেছে। সে পরদেশীকে হাত ধরে বারান্দায় এনে বসায়। তার পরে মৃদুস্বরে বলে, কান্না আমাদের মানায় না। আমরা কাঁদব না।
পরদেশী তার দিকে তাকিয়ে বলে, চোখের জল আটকানো কঠিন। জল আটকালে বুক ফাটবে। দেখব নর্দমা সাফ করতে গিয়ে ওখানে মরে পড়ে আছি। অহেতুক মরার চেয়ে একটাকে মেরে মরাই তো উচিত।
আলতাফ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। দুজনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বলে, জয় বাংলা।
কেউ এসেছে সাড়া পেয়ে ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে আসেন আকমল হোসেন, আয়শা খাতুন ও মেরিনা। ওদের দেখে প্রথমে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেও অল্পক্ষণে নিজেকে সামলায় পরদেশী। আকমল হোসেন ওর পাশে বসে ঘাড়ে হাত রাখেন। পরদেশী চোখ মুছে নীলুফারের কথা বলে, রাবেয়ার ঝুলে থাকার কথা বলে। চালতাগাছ, শ্রাবণের বৃষ্টি, সাদা ফুলের কথা বলতেও ও ভোলে না। নীলুফারের জন্য ও কোথায় থেকে ছুরি কিনেছে, সে কথা বলে। কয়েক দিন ছুরিটা নর্দমায় লুকিয়ে রেখেছিল, সে কথা বলে। রাবেয়ার সাহসের কথা বলে। ঘটনার দিন রাবেয়া ওকে বলেছে, ছুরির কথা আমি একা স্বীকার করব। কোনো কথা না বলে স্বীকার করা। তুই কিছু জানিস না, পরদেশী। মেয়েগুলোর দেখাশোনার জন্য তোকে এখানে থাকতে হবে, পরদেশী। তোর ধরা পড়া চলবে না। মনে থাকবে তো?
থাকবে। আমি দম বন্ধ করে মাথা নেড়েছিলাম। এই রাবেয়াকে আমি বাইশ বছর ধরে চিনি। চাকরি শুরুর প্রথম থেকে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাবেয়া আমাকে চোখ খুলে দিয়েছে। আমি রাবেয়াকে ফুটে উঠতে দেখেছি। ওহ্, রাবেয়া।
পরদেশী বেশ কিছুক্ষণ ধরে কাঁদে। কেউ ওকে কাঁদতে মানা করে না। সবাই ভাবে, ও কেঁদে নিজেকে হালকা করুক। অনেকক্ষণ ধরে কেঁদে ও চোখ মোছে। আলতাফ ওর জন্য খাবার নিয়ে আসে। ও আয়শার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বলে, মাইজি, আজ আমি খেতে পারব না। আমাকে জলও ছুঁতে বলবেন না, মাইজি।
আয়শা ওর মাথায় হাত রেখে বলেন, তুমি সুস্থ থাকো, পরদেশী। ভালো থাকো, এই প্রার্থনা করি। এই দরজা তোমার জন্য খোলা থাকবে। যখন খুশি আসবে।
সবাইকে স্তব্ধ বসিয়ে রেখে পরদেশী চলে যায়। যেন অনন্তকাল বয়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। অনেকক্ষণ পর আয়শা খাতুন বলেন, চলো, আমরা ওদেরজন্য প্রদীপ জ্বালাই।
হ্যাঁ। চলো। ওদের স্মরণে গুনগুন ধ্বনি হবে না?
হবে। আয়শার ভেজা কণ্ঠস্বর শুনে আকমল হোসেন মনে করেন, একই ক্ষরণ তার ভেতরেও হচ্ছে। তাদের দূরে সরার উপায় নেই।
একই ভাবনা নিয়ে মেরিনা উঠে যায় প্রজ্বলিত মোম আনার জন্য।
গুনগুন ধ্বনি বয়ে যায় ঘরে। আয়শার মনে হয়, আজ ওর হৃদয়ে মৃদু কাপন। তার পরও সুর ওঠে
ভয়েরে মোর আঘাত করো ভীষণ, হে ভীষণ।
কঠিন করে চরণ ’পরে প্রণত করো মন।।
গানের সুর মেরিনাকে আপ্লুত করে। ও তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। মায়ের দৃষ্টি মোমবাতির শিখার ওপর—ধেয়ে যায় গুনগুন ধ্বনি–
বেঁধেছ মোরে নিত্য কাজে প্রাচীরে-ঘেরা ঘরের মাঝে
নিত্য মোরে বেঁধেছে সাজে সাজের আভরণ।।
আকমল হোসেনের মনে হয়, আয়শা গানটি তার জন্য গাইছেন। বাঁশির সবটুকু তার বুকের ভেতরে গেঁথে যাচ্ছে। তিনি প্রবল মনোযোগে গানটি শোনার জন্য কান পেতে রাখেন। আয়শা খাতুন দৃষ্টি সামনে ছড়িয়ে দেন–
এসো হে ওহে আকস্মিক, ঘিরিয়া ফেলো সকল দিক৷৷
মুক্ত পথে উড়ায়ে নিক নিমেষে এ জীবন!
তাহার পরে প্রবেশ হোক
উদার তব সহাস চোখ—তব অভয় শান্তিময় স্বরূপ পুরাতন।।
গানের রেশ শেষ হওয়ার আগেই আয়শা উঠে যান। হাঁটতে হাঁটতে গেয়ে শেষ করেন বাকিটুকু। মোমবাতির শিখা নিবুনিবু হয়ে আসে। ফোন বেজে ওঠে। আকমল হোসেন উঠে ফোন ধরেন।
হ্যালো, আঙ্কেল, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি আগে, আমি আরিফ, আঙ্কেল। আজ আমরা মন্ত্রীর গাড়িতে গ্রেনেড ছুড়েছি।
কোন মন্ত্রী, আরিফ?
মাওলানা মোহম্মদ ইসহাক।
ও বুঝেছি, মৌলিক গণতন্ত্র ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন দপ্তরের মন্ত্রী। তার পার্টি নেজামে ইসলাম। ঘটনাটা কোথায় ঘটালে?
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায়। সময় ছিল বেলা বারোটা পঞ্চাশ মিনিট। মাওলানা লালবাগে নেজামে ইসলামের এক কর্মিসভায় যোগদান করে সেক্রেটারিয়েটের দিকে যাচ্ছিল। লালবাগের এক রেস্তোরাঁয় বসে মন্ত্রীকে ফলো করার জন্য অপেক্ষা করি। আবুল হোন্ডার নাম্বার প্লেটে আবছাভাবে চুন লাগিয়ে নিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে ছিল গ্রেনেড-৩৬ ও ফসফরাস-৭৭।
মন্ত্রী বের হলে আমরা তার গাড়ির পিছু নেই। গাড়ি মেডিকেল কলেজের সামনে আসতেই ট্রাফিকের লাল আলো জ্বলে ওঠে। গাড়ি থেমে যায়। আমরা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হাত ঢুকিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে দিই। তারপর হোন্ডা নিয়ে ছুটে যাই। পেছনে শুনতে পাই বিস্ফোরণের শব্দ।
কনগ্রাচুলেশন! তোমাদের জন্য দোয়া করি, বাবা।
ফোন রেখে দেন তিনি।
আয়শা খাতুন পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, সফল অপারেশন?