লোকটি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করে, বল, ছুরি কোথায় পেয়েছিস?
একজন মুক্তিযোদ্ধা দিয়েছে।
নাম কী?
জানি না।
বল, নাম কী?
বাইরে থেকে মুক্তিযোদ্ধা ঢুকতে পারবে না। তাহলে ভেতরের কেউ।
বুট চেপে বসে শরীরের ওপর। তখন সাদা ফুলের ওপর নীলুফারের হাত। ও ফুলটিকে অক্ষত রাখতে চায়। শান্তির-স্বাধীনতার এই ফুল যেন ওরা থেতলাতে না পারে।
নীলুফারের মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ ধ্বনি বের হয়।
কথা বলবি না? এত তেজ কিসের?
পাঁচ-পাঁচটি বুট ওর শরীর চেপে ধরলে ও ঘাড় কাত করে। দম বেরিয়ে যায়। চুলের পাশে আশ্চর্য সজীব হয়ে থাকে চমক্কার সাদা-হলুদ রঙের চালতা ফুল।
ড্রেনের পাশে বসে থাকে সুইপাররা। আজ ওরা সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। সবার আতঙ্ক রাবেয়াকে নিয়ে। ও মেয়েগুলোর দেখাশোনা করেছে। দায়টা ওর ওপর বেশি আসবে। নির্দেশ হয়েছে, কেউ যেন পুলিশ লাইনের বাইরে না যায়। গেলে, চাবুক দিয়ে পিটিয়ে জর্জরিত করা হবে।
সেনারা যত বলছে, তার চেয়ে বেশি বলছে বাঙালিগুলো। বলছে, কার গায়ে হাত দিয়েছিস, বুঝবি। স্বাধীনতার সাধ মিটিয়ে দেব।
রাবেয়া চুপচাপ থাকে। পরদেশী ওকে এক খিলি পান দিয়েছিল, সেটা চিবোয়। মেয়েদের চিৎকার ভেসে আসছে। ওর বুক ধড়ফড় করে। একটু পরে দেখতে পায়, মেয়েগুলোকে মারতে মারতে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। ব্যারাক খালি করে ফেলছে ওরা। রাবেয়া বুঝে যায় যে ওদেরকে কোথাও নামিয়ে দেবে। লাথি দিয়ে নামাবে। তারপর নতুন মেয়েদের নিয়ে ভর্তি করবে ব্যারাক। ও দুহাত পেছনে দিয়ে ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে নীরব হয়ে যায় এলাকা। থমথম করে চারদিক। সুইপার কয়েকজন ড্রেনের পাশে বসে থাকে। রাবেয়া খাতুন পা মেলে দেয়, আবার পা গোটায়। পরদেশীর দিকে তাকিয়ে বলে, আমার একটা কাজ করা হলো না। আর করা হবে বলে মনে হয় না।
কী কাজ? কোনো কাজই আর করা যাবে না। আমাদেরকেও হয়তো বের করে দেওয়া হবে। চাকরি খতম। তার পরও বল, কী কাজ করতে চেয়েছিলি?
ঝরনাকে কথা দিয়েছিলাম যে সুইপারের কাপড় পরিয়ে ব্যারাক থেকে বের করে দেব। হলো না।
পরদেশী সঙ্গে সঙ্গে বলে, এই জন্য তুই আমার বউয়ের পুরান শাড়ি চেয়েছিলি?
তুই বলেছিলি, দিবি। তোর কাছে ওর দুটো শাড়ি আছে, তার একটা দিবি।
আমি তো কাগজে মুড়ে রেডি করে রেখেছিলাম। আনার সময় তো পেলাম।
তোরা চুপ কর। ওই দেখ, পাঁচজন পুলিশ আমাদের দিকে আসছে। এবার বোধ হয় আমাদের পালা।
রাবেয়া সোজা হয়ে বসে বলে, কী আর করবে। কচু করবে। যা করবে করুক। তোরা কিন্তু ওদের হাতে-পায়ে ধরবি না।
কেউ কোনো কথা বলে না। শুধু সামনে তাকিয়ে থাকে। যমদূতের মতো এগিয়ে আসার দৃশ্য দেখে।
ওরা পাঁচজন এসে সামনে দাঁড়ায়। সরাসরি রাবেয়ার দিকে তাকায়।
তোকে নিয়ে যেতে বলেছে। আমাদের সঙ্গে আয়। সাহস দেখিয়েছিস। এখন ঠেলা বুঝবি।
যাচ্ছি। আমাকে ভয় দেখানোর দরকার নেই।
রাবেয়া সামনে এগিয়ে যায়। একটু জোরেই যায়। দেখাতে চায় যে তোদেরকে ডরাই না। ওর ভেতরে এখন আর মৃত্যুভয় কাজ করছে না। ভয় করবে কেন? এর জন্য তো ওর প্রস্তুতি ছিল। ও শাড়ির আঁচল কোমরে পেঁচায়। ওর কাঁচা-পাকা চুল বাতাস এলোমেলো করলে ও দুহাতে খোঁপা বাঁধে।
পেছন থেকে একজনে ছোট লাঠি দিয়ে গুঁতো দেয়। ও ফিরে রুখে দাঁড়ায়। চোখ জ্বলে ওঠে। নিজেকে বোঝায় যে মৃত্যু সামনে থাকলে সাহসী হতে হয়।
মারছ কেন? যেতে বলেছ, যাচ্ছি। দোষ করলাম কী?
গেলে টের পাবি, হারামজাদি। বেশ্যার হাতে ছুরি দিয়েছিস তুই। তুই ছাড়া আর কে দেবে?
কেউ একজন পাছায় লাথি দিলে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। পরদেশী ছুটে এসে রাবেয়াকে টেনে তোলে।
সুইপার এবং ডোমরা এতক্ষণ ওদের পিছে পিছে আসছিল। রাবেয়াকে সামনে রেখে ছোটখাটো একটা মিছিল যেন। পুলিশের হাঁকে বন্দীদের মিছিল।
পরদেশী মৃদুস্বরে বলে, ব্যথা পেয়েছিস, জানি। উঠে দাঁড়া। আমাকে ধর।
রাবেয়া উপুড় হয়ে পড়েছিল। উঠতে কষ্ট হচ্ছে। ঠোঁট কেটে গেছে। হাঁটু ইটের ওপর পড়ে টনটন করছে। চামড়া উঠেছে।
পরদেশী আস্তে করে আবার বলে, ওঠ।
পারছি না। পা টনটন করছে। হাঁটু বুঝি ভেঙেই গেছে।
উঠে দাঁড়া, নইলে আবার লাথি দেব।
পরদেশী টেনে তুললে রাবেয়া উঠে দাঁড়ায়। বুঝতে পারে, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। ও পরদেশীর হাত চেপে ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে।
রাবেয়াকে অফিসে এনে প্রথমে চাবুক দিয়ে মারা হয়। জিজ্ঞেস করা হয়, মেয়েটিকে ছুরি দিয়েছে কে?
রাবেয়ার মুখে কথা নেই।
বল, কথা বল। কেন ওকে ছুরি দিয়েছিস?
রাবেয়া কথা বলে না।
ওর শরীরের ওপর পাঁচটি বুট উঠে আসে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অন্য সুইপাররা। ওরা সবাই জানে, রাবেয়া কথা বলবে না। রাবেয়া মরে যাবে, তা-ও কথা বলবে না।
একসময় অফিসার হুকুম দেয় ওকে গাছে ঝুলিয়ে রাখার। বলে, ও ঝুলে থেকে মরবে। ওকে উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে দাও। পা বেঁধে ঝোলাবে, ওর মাথা নিচের দিকে থাকবে। কাক এসে ওকে ঠোকর দেবে। শকুন এসে ওর মাংস খুবলে তুলবে। ওকে মারার জন্য গুলি খরচ করা হবে না। ওর শাস্তি ঝুলে থেকে একটু একটু করে মরণ।
হুকুম শুনে সুইপাররা চোখ মোছে। ওরা বুঝে যায় যে রাবেয়াকে মেরে ফেলা হবে। ওকে বাঁচানোর আর কোনো সুযোগ নেই। এই চালতাগাছের নিচে রাবেয়াকে কখনো বসতে দেখেনি ওরা। এ গাছের ফুল কখনো খোপায় দেয়নি রাবেয়া। মৃত্যুর সময় গাছ ওকে বুকে টেনে নিয়েছে। ওই গাছে ঝুলে থেকে রাবেয়ার স্বাধীনতার স্বপ্ন ফুল হয়ে ফুটবে।