দুপুরের খাবার আসে ব্যারাকে।
মেয়েরা বারান্দায় লাইন করে বসেছে। ওরা ক্ষুধার্ত। বালতি ভরা ডাল। গরুর মাংস আর আলুর তরকারি। ওরা হাপুস-হুপুস খায়। শুধু খেতে পারে না নীলুফার। এক গ্রাস মুখে দিলে গিলতে ওর সময় লাগে।
রাবেয়া একটু দূরে বসে ছিল। ওর নজর ছিল নীলুফারের ওপর। যতক্ষণ ক্যানটিনের সেপাইরা খাবার দিচ্ছিল, ততক্ষণ রাবেয়া দূরে ছিল। ও কাছাকাছি আসুক, সেটা ওরা চায় না।
ওরা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই রাবেয়া নীলুফারের মুখোমুখি এসে বসে।
খাচ্ছ না যে? দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছ। আজ তো গরুর মাংসের তরকারি দিয়েছে। শুধু ডাল না। খাও।
খেতে পারছি না। খেতে ভালো লাগছে না।
না খেলে শরীর ভালো থাকবে?
শরীর? কার জন্য? ওই লুচ্চাদের জন্য?
লুচ্চাদের জন্য না, নিজের জন্য।
বাঁচার সাধ নাই। শরীর এখন বোঝ। বোঝা টানতে চাই না।
নীলু, দেখো। তুমি যা চেয়েছিলে তা আছে। বেশি বড় না, তবে কাজ হবে। খুব ধার আছে। পরদেশী এনেছে।
রাবেয়া ব্লাউজের ভেতরে ছুরি রাখার ইঙ্গিত করে। নীলুফার বুঝে যায়।
তোমার কাছে রাখো। নেব। তুমি ভাত খাবে?
মাথা খারাপ। আমাকে খেতে দেখলে মারবে। তুমি তো জানো সব।
তে দেখলে মারইয়া তুমি আমারটা খাও। এই প্লেটে যা আছে তা। আমি আমার ভাগ তোমাকে দিচ্ছি।
না, না, তুমি আমাকে খেতে বলো না।
একপাশ থেকে এইটুকু খেয়েছি। এঁটো হয়নি।
না গো, খেতে বলল না। খিদায় জীবন গেলেও খেতে পারব না। চাবুক দিয়ে মারবে। তুমি কি চাও যে আমার পিঠ কেটে রক্ত পড়ুক?
নীলুফার আর কথা বলে না। উঠে হাত ধুয়ে নেয়। বারান্দার কোনায় দাঁড়িয়ে রাবেয়ার কাছ থেকে ছুরিটা নেয়। কলা পাতাটায় ভালো করে প্যাচিয়ে নিজের কোমরের কাছে পায়জামার সঙ্গে গুঁজে রাখে। রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আমাকে ওই সাদা ফুলটা এনে দেবে, রাবেয়া খালা, এমন সুন্দর ফুল আমি কোনো দিন দেখিনি। কী ফুল ওটা?
রাবেয়া ভালো করে তাকিয়ে দেখে, ব্যারাকের দেয়ালের পাশে যে ফুলটি ফুটেছে, ওটা একটা চালতাগাছ। সাদা বড় পাপড়ি-মাঝে হলুদ রঙের খানিকটাতার ওপরে সাদা ছোট্ট ফুল, ওর মাঝে আবার একটু হলুদ রং-রাবেয়া তাকিয়ে থাকে। এর বেশি বর্ণনাও করতে পারে না। প্রতিবছর বর্ষায় এই ফুল ফোটে। আষাঢ় শেষ হলে শ্রাবণের শুরুতে বৃষ্টিতে ভিজে ফুলের পাপড়ি মেলে ওঠে। কারুকাজ করা পাতার মধ্যে এমন সাদা ফুল দেখা খুব ভাগ্যের মনে হয় রাবেয়ার।
মাঝেমধ্যে ও নিজেও এই ফুলটা দেখে। এত সুন্দর! হঠাৎ ওর বুক ধড়ফড় করে ওঠে। এই মৃত্যুপুরীতে দাঁড়িয়ে মেয়েটির চোখ গেছে ফুলটির দিকে। আশ্চর্য! একটি ছুরি নিজের কোমরে গুঁজে রেখে ফুলের নাম জানতে চায় কেন মেয়েটি? মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরার খুব সাধ হয় ওর। কিন্তু ধরতে পারে না। সাহস হয় না। যে মেয়ে মৃত্যু সামনে রেখে ফুল খোঁজে, তাকে স্পর্শ করার সাধ্য হয় না রাবেয়ার। ও নিজের ভেতর অভিভূত হয়ে থাকে।
কী ভাবছ, খালা? ফুলের নামটা তো বললে না?
ওটা তো চালতা ফুল।
চালতা ফুল? আমি নুন-মরিচ মাখিয়ে চালতা খেয়েছি। কিন্তু ফুল দেখিনি। ও মা গো, এত সুন্দর ফুল! আমার জন্য একটা ফুল ছিঁড়ে আনো, খালা।
কী করবে?
ওটা একটা শান্তির ফুল।
কী করবে?
মরণের আগে খোপায় খুঁজে রাখব। এই মরণের খাঁচায় কালই আমার শেষ দিন।
রাবেয়া দুহাতে মুখ ঢাকে।
নীলুফার ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, কেঁদো না। এটা আমার গৌরবের মৃত্যু। এই মৃত্যুর কথা ছড়িয়ে দিয়ে চারদিকে।
পুলিশরা উঠে আসে বারান্দায়। রাবেয়া দ্রুত পায়ে অন্যদিকে সরে যায়। ও জানে, এখন থালাবাসন গোছানো হবে। তারপর মেয়েদের ঘরে ঢুকিয়ে তালা দেওয়া হবে।
পরদিন কিছু ঘটাতে পারে না নীলুফার।
তার পরদিনও না।
তৃতীয় দিনে একজন নগ্ন ধর্ষকের পেটে ঢুকে যায় নীলুফারের ছুরি। ওর চিকার যখন ঘরের চারদেয়ালে আছড়াতে থাকে, তখন নীলুফার হাসতে হাসতে বলে, এটা আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। তোমাদের একটাকে না মেরে আমি এই আজাবখানা থেকে বের হব কেন, কুত্তার বাচ্চারা!
ও হাত বাড়িয়ে অপরূপ শান্তির ফুলে হাত রাখে।
গত বিকেলে বাড়ি যাওয়ার আগে একটি ফুল ওকে দিয়ে গেছে রাবেয়া। ও ধীরেসুস্থে ওর নিজের কাপড় পরে। দেখতে থাকে লোকটির মৃত্যু। প্রবল রক্তস্রোতের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে ওর নাড়িভুঁড়ি।
খবর ছড়িয়ে যায় পুলিশ লাইনের চারদিকে। ছুটে আসে অফিসার এবং পুলিশ। শত শত সেপাই জড়ো হয় ব্যারাকের সামনে। প্রত্যেকে বিস্মিত, হতভম্ব। এত সাহস মেয়েটির! কোথায় থেকে এত সাহস পেল? ছুরি কোথায় পেল? সবার চোখে ধুলা দিয়ে কোনো মুক্তিযোদ্ধা কি ব্যারাকে ঢুকেছিল? কীভাবে ঢুকল? চারদিকে এত পাহারার মধ্যে ঢোকা তো সম্ভব না, তাহলে কেউ কি সাহায্য করেছে? যদি করে থাকে, তাহলে সে কে?
বারান্দায় পাঁচজনের বুটের নিচে চিত হয়ে পড়ে আছে নীলুফার। ওরা তখনো বুট দিয়ে পিষ্ট করেনি ওকে। ওর কাছ থেকে জানতে হবে, কে ওকে সহযোগিতা করেছে। ও ছুরি কোথায় পেল?
একটু আগে মৃত অফিসারের লাশ সরানো হয়েছে। স্ট্রেচারে করে তুলে নিয়ে গেছে তাকে। বারান্দায় পড়েছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। সে রক্ত উত্তেজিত সেনাদের বুটের নিচে গড়াচ্ছে। বারান্দায় লেপ্টে যাচ্ছে। সেই রক্তমাখা বুট এখন নীলুফার শরীরের ওপর। ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ও নিজেও চেষ্টা করছে প্রতিটি নিঃশ্বাস না ফেলার জন্য। ওর ডান হাত শুধু চুলে গুঁজে রাখা সাদা ফুলটির ওপর রাখা আছে। ওকে বুট দিয়ে পিষ্ট করলে ওর হাত ওখান থেকে ছিটকে পড়বে। ওকে ওরা উর্দুতে প্রথমে প্রশ্ন করে। ও কোনো উত্তর দেয় না। পরে একজন বাঙালিকে লাগানো হয়।