মেরিনাও ফিসফিসিয়ে বলে, পারতে হবে। যুদ্ধের সময় পারব না কথা কেউ শুনতে চাইবে না।
আরে বাবা, ফিলসফারের মতো কথা বলছ।
চুপ করেন, মা শুনবে।
খালাম্মা রান্নাঘরে, খালুজান হাত ধুতে গেছেন। বাকি আমরা সবাই শুনেছি।
তখন আকমল হোসেনের চপ্পলের শব্দ পেয়ে ওরা সোজা হয়ে বসে। আকমল হোসেন ডাইনিং টেবিলের দিকে আসতে আসতে বলেন, তোমাদের সঙ্গে আরেকটু সময় কাটাতে চাই, বাবারা। তোমাদের এখনো পায়েস খাওয়া হয়নি দেখে আমি খুশি। পায়েস খেতে খেতে যেটুকু সময় তোমাদের কাছ থেকে পাব, এটাও আমার বড় পাওয়া।
মেরিনা বাবার সামনে পায়েসের বাটি রেখে বলে, মায়ের রান্নাটা তাহলে আপনারই বেশি কাজে লাগল। তাই না, আব্বা?
নাহ্, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পারা যায় না। সময়মতো দিল আমাকে ঘায়েল করে।
মেরিনা হাসতে শুরু করলে আকমল হোসেন নিজেও ওর পিঠ চাপড়ে হাসতে শুরু করেন। পায়েসের বাটি টেনে নিয়ে মুখে এক চামচ দিয়ে বলেন, এই বিষয়টি তোমাদের আমি পরে বলব।
ছেলেরা শোনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে না। যার যার সামনে রাখা পায়েসের বাটি থেকে খেতে শুরু করে। প্রত্যেকের মনে হয় আজ এক অন্য রকম পায়েস খাওয়া হচ্ছে। মেরিনার কাছে আরেকটু চাওয়ার সুযোগ আর হয়ে ওঠে না।
আকমল হোসেন পায়েস শেষ করে বাটিটা সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলেন, দশ দিনের সফরসূচি নিয়ে বিশ্বব্যাংক এখন ঢাকায়। প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান ঢাকায়। তিনি জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর রিফিউজিজ। তারা ঢাকার পরিস্থিতি বুঝতে এসেছে। পাকিস্তান সরকার তাদের বোঝাতে পারছে না যে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে, তা কেবল কিছুসংখ্যক বিচ্ছিন্নতাবাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ মাত্র।
ছেলেরা উদ্গ্রীব হয়ে শোনে। কারও মুখে কথা নেই। স্বপন বলে, আমরা এতকিছু জানি না।
তোমাদের জানার জন্য বলছি, বাবারা। পাকিস্তান সরকার এদের বোঝাতে চাইছে যে বিদ্রোহীদের দমন করার পর আইনশৃঙ্খলা-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। সশস্ত্র সেনাবাহিনী রিলিফ ও পুনর্বাসনের কাজে প্রাদেশিক সরকারকে সহযোগিতা দিচ্ছে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় অনবরত প্রচারের পরও পাকিস্তান সরকার তাদের চোখে ধুলো দিতে পারছে না।
কায়েস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করা তো কঠিন, খালুজান। সীমান্তের ওপারে থেকেও আমরা ছিটেফোঁটা খবর পাচ্ছিলাম।
আপনার কাছে আমরা আরও শুনতে চাই, খালুজান। এসব জানা থাকলে আমাদের অপারেশন পরিকল্পনা করতে সুবিধা হবে।
বাদল কথাগুলো বলতে বলতে উত্তেজিত কায়েসকে হাত টেনে চেয়ারে বসায়। অন্য ছেলেরা উসখুস করে। যড়যন্ত্রের সুতা ছিঁড়তে চায়। ওদের চেহারা কাঠিন্যে ঢেকে যায়। ওরা বুঝতে পারে, এই সময়কে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরি। তখন আকমল হোসেন বলতে শুরু করেন আবার, এখনকার সংবাদপত্র আমাদের সবকিছু সরাসরি বলে না। খবরের ভেতর থেকে আমাদের না-বলা খবর বুঝে নিতে হয়। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এইড-টু পাকিস্তান কনসোর্টিয়ামের চেয়ারম্যান পিটার কারগিল তার সহকর্মীদের নিয়ে ঢাকায় কেন, জানো? ওরা এসেছে নানা কিছু যাচাই করতে। যেমন পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যের যাচাই, মে-জুন মাসের কিস্তি তিন কোটি ডলার শোধ দেওয়া এখন সম্ভব নয় বলে ছয় মাস সময় চেয়ে পাকিস্তান সরকারের আবেদন, এমন কিছু বিষয়। আবার জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে যে সাহায্য দেওয়া হবে, তা জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। পাকিস্তান সরকার এই সিদ্ধান্তে রাজি নয়। তারা বিবৃতি দিয়েছে যে এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে গোলযোগের কারণে যেসব পাকিস্তানি বিদ্রোহী ও দুষ্কৃতিকারীদের হুমকির মুখে সীমান্তের অপর পারে চলে গেছে, তাদের ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করবে। এ জন্য ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার বিভিন্ন পথে অভ্যর্থনাকেন্দ্র খোলা হবে। এসব বিষয় দেখার জন্য এসেছেন প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান।
খালুজান, এরা সবাই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আছে। তাই আমাদের লক্ষ্য এদের নাকের ডগায় গ্রেনেড ফাটানো। ওরা যেন বুঝতে পারে, পরিস্থিতি মোটেই শান্ত নয়।
ঠিক। এভাবে রেগুলার আর্মির পাশাপাশি চাই গেরিলাবাহিনী। আমিও তোমাদের সঙ্গী একজন গেরিলা।
ওরা চেয়ার ছেড়ে উঠে আকমল হোসেনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
আব্বা, আমি পারলে আপনাকে মেলাঘর ক্যাম্পে নিয়ে যেতাম।
তুমি যখন কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে গেলে তখন ভাবিনি যে বুড়ো বাবাও যেতে পারত। তারও সাহস আছে, যুদ্ধ করার শক্তি আছে।
মিজারুল দুহাত নেড়ে বলে, আপনি গেলে ঢাকা শহরের এই দুর্গ আমরা কীভাবে পেতাম।
ওমর আকমল হোসেনের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলে, খালুজান, আমাদের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বলেন, ঢাকায় গেরিলা তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমার প্রচুর ছেলের দরকার। আমি যে কয়জন ছেলে পেয়েছি তা আমার জন্য যথেষ্ট নয়, তোমরা যে যত পারো ছেলেদের নিয়ে আসবে। আমি দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে গ্রহণ করব। প্রশিক্ষণ দেব। আপনি গেলে তিনি আপনাকেও ট্রেনিং দিতেন।
আকমল হোসেন হেসে বলেন, আপাতত আমি তোমাদের গাড়িচালক। তোমাদের প্রথম অপারেশনে আমি যে থাকতে পারছি, এটাই আমার ভাগ্য। আমরা অবশ্যই বিজয় নিয়ে ঘরে ফিরব।