আমরা তো টের পাচ্ছি। আব্বা খুবই খুশি।
বলা যায়, পুরো রূপগঞ্জ থানা গেরিলা ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ধরে যে মিলগুলো আছে, সেখানে শুরুর দিকে আর্মির বাংকার ছিল। গেরিলা আক্রমণের কারণে তারা বেশ নাজেহাল হয়ে পড়েছে। বাংকার গুটিয়ে পিছু হটেছে। মনে হয়, আস্তে আস্তে কেটে পড়বে। স্থানীয় পাঠশালায়, আমরা যেখানে থাকি, ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা, আমরা তো সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছি। এই পতাকাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণের চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুই করতে পারেনি। এমনকি হেলিকপ্টারে করে কমান্ডাে নামানোর চেষ্টা করেছিল। নামাতে পারেনি। আমরা বুঝে গেছি যে আমরা ওদের মুখোমুখি হওয়ার সমান হয়েছি। আমরা গুল টেক্সটাইল মিলের বাংকার আক্রমণ করেছিলাম। বড় একটি এলাকা নিয়ে যুদ্ধ হয়। শেষ পর্যন্ত ওরা সাতাশটি লাশ ফেলে রেখে পিছু হটে যায়। গেরিলারা বড় আকারের প্রতিরোধব্যুহ রচনা করে। আমরা ভাবছি, স্বাধীনতার জন্য আমাদের আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
এটুকু বলে মারুফ থামে।
মেরিনা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ও বলে, কয়টা পিঠা খাব রে?
পিরিচে যা আছে, তার সবগুলো। একটাও বাদ দিতে পারবে না।
হা হা করে হাসে মারুফ।
ছুটে আসে আলতাফ আর মন্টুর মা।
কী হয়েছে? কোনো খুশির খবর আছে?
হ্যাঁ, আছে। যুদ্ধের খুশির খবর আছে বলেই তো হাসতে পারছি।
কী, কী খবর?
দুজনে কাছে এসে দাঁড়ায়।
আমাদের যুদ্ধের দিন ফুরিয়ে আসছে। আর বেশি দিন যুদ্ধ করতে হবে। আমরা জয়ী হবই।
সত্যি?
একদম সত্যি। আপনারা নিজেদের কাছে পতাকা রাখবেন। স্বাধীনতার খবর পেলেই পতাকা ওড়াবেন।
মন্টুর মা মারুফের মুখোমুখি বসে পড়ে। আলতাফ সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে বলে, ওরা যত হারবে তত হিংস্র হবে। মরণকামড় দিতে পারে। আলতাফ দুপা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বলে, দেবেই। ওরা তো খালি হাতে এখানে মরতে আসেনি।
ঠিক বলেছেন, আলতাফ ভাই।
মেরিনাও সায় দিয়ে বলে, একদম ঠিক।
তখন বাইরে থেকে ফিরে আসেন আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন। মারুফকে দেখে দুজনে খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে যান। আকমল হোসেন ওকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তুই কেমন আছিস, বাবা? আয়শা খাতুন ওকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোর শরীরে বারুদের গন্ধ পাচ্ছি, বাবা।
সব অপারেশনে জিতেছি বলে বারুদের গন্ধ আমাদের শরীরের গন্ধ, আম্মা। আমরা সময়কেও গায়ে মেখে রেখেছি।
চল, ঘরে চল।
রাতের খাবারের পরে ড্রয়িংরুমে এলে আকমল হোসেন মেরিনাকে বলেন, মা, মারুফের একটা চিঠি আছে তোমার কাছে। নিয়ে এসো।
মেরিনা উঠে যায়। নিজের ঘরের দরজার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। তারপর পড়ার টেবিলের ওপর থেকে চিঠিটা নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে আসার সময় শুনতে পায় মারুফের কণ্ঠস্বর। নিজের ঘরে যাওয়ার সময়ও একবার মারুফের কণ্ঠস্বর শুনেছে। তখন ওর জিজ্ঞাসার উত্তর কেউ দেয়নি। মেরিনা ড্রয়িংরুমে এলে শুনতে পায় মারুফ আবার একই কথা বলছে।
চিঠি? আমার? কে লিখেছে? আপনারা তো জানেন কে লিখেছে। তাহলে বলছেন না কেন?
আয়শা খাতুন মৃদুস্বরে বলেন, জেবুন্নেসা।
জেবুন্নেসা! মারুফ সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। মেরিনার দিকে যাওয়ার জন্য দুপা এগিয়ে আবার ফিরে দাঁড়ায়। কাউকে সরাসরি উদ্দেশ না করেই বলে, ও কেন এ বাড়িতে চিঠি লিখবে? ও কোথায় আছে, জানি না। শুনেছি ওরা বাবামায়ের সঙ্গে গ্রামে কোথাও চলে গেছে। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আকমল হোসেন বলেন, বস, বাবা। আগে চিঠিটা পড়।
আপনাদের সঙ্গে ওর কোথায় দেখা হলো?
আমাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। পাকিস্তানি সেনারা ওকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ওদের নির্যাতনে ও মারা যায়। তার আগে একটি চিঠি লিখে পুলিশ লাইনের সুইপার রাবেয়াকে দিয়ে বলেছিল এই বাড়িতে পৌঁছে দিতে। মনে হয়, এই বাড়ির ঠিকানা ওর কাছে ছিল। আমরা চিঠিটা যত্ন করে রেখেছি।
মেরিনা চিঠিটা মারুফের হাতে দেয়। চিঠির খামে ও আতর মাখিয়ে রেখেছিল। মারুফ চিঠি খোলার সময় আতরের গন্ধ সবার নাকে লাগে।
চিঠি পড়ে মারুফ প্রবল যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়। দুহাতে মুখ ঢাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি জেবুন্নেসাকে দেখেছি, ভাইয়া। তেমন আলাপ ছিল। এখন মনে হচ্ছে, কেন যে আমার সঙ্গে আলাপ হলো না!
মারুফ শূন্যদৃষ্টিতে মেরিনার দিকে তাকায়। বুঝতে পারে, ওর ভেতরে বোধ কাজ করছে না। ও মেরিনাকে চিনতে পারছে না। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে একজন অচেনা মানুষ তার সামনে বসে আছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, তাকে কখনো কোথাও দেখেনি ও। ঘরটা রূপগঞ্জের একটা ক্যাম্প-মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। ওখানে দাঁড়িয়ে জেবুন্নেসা ওকে বলছে, একটি মিলিটারি কনভয় উড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি সুইসাইডাল অ্যাটাক করতে চাই। বোমাটা আমার শরীরের কোথায় বাধলে ঠিক হবে?
আমাকে ভাবতে দাও, জেবুন্নেসা। দুজনে মিলে ঠিক করব যে, কীভাবে কী করা যায়। তবে শরীরে বোমা বেঁধে তুমি ঝাঁপিয়ে পড়বে কেন? আমিও পড়তে পারি।
না, তুমি যুদ্ধ করবে। ফ্রন্টে যাবে। যদি তোমাকে যুদ্ধের শেষ মানুষটি হতে হয়, তুমি তা-ই হবে। আমি কাজ ভাগ করে নিতে চাই। ওহ্, জেবুন্নেসা! ও পাগলের মতো মাথা ঝাঁকায়।
আকমল হোসেন ওর পাশে এসে বসেন। ঘাড়ে হাত রাখেন। মেরিনা একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে এনে বলে, চলো, তোমার ঘরে দিয়ে আসি।