আকমল হোসেন ওদের পরিকল্পনার কথা জানেন। ওরা লুঙ্গি আর শার্ট পরে যাবে। পাওয়ার স্টেশনের পাহারায় থাকা দুজন পুলিশকে হ্যান্ডস আপ করাবে নজরুল ও মীজান। অসীম জুডো জানে। ও কায়দা করে প্রহরীদের ফেলে দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলবে। তারপর ইমপ্রোভাইজড গ্রেনেড ফিট করে বিস্ফোরণ ঘটাবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী অ্যাকশন শুরু হয়।
পুলিশদের পাশ কাটিয়ে স্টেনগান হাতে ভেতরে ঢুকে পড়ে নজরুল ও মীজান।
ধমক দিয়ে বলে, হ্যান্ডস আপ।
গোঁ গোঁ করতে থাকে দুজনে। নিজেদের রাইফেল নামিয়ে রেখে হাত তুলে দাঁড়ায়।
চুপ, শালারা। শব্দ করবি না।
ওরা আতঙ্কে মূর্তিবৎ দাঁড়িয়ে থাকে। অসীম কারাতের আঘাতে কাত করে ফেলেছে প্রহরীদের। জসীম আর শিবলি ইমপ্রোভাইজড গ্রেনেড ফিট করে ফেলেছে।
মাত্র কয়েক মিনিট।
প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। নিহত হয় একজন প্রহরী।
ওরা ততক্ষণে হাওয়া।
ফেরার পথ করে নেয় শাজাহানপুরের ভেতর দিয়ে। আকস্মিকভাবে লোকোশেডের কাছে স্থাপিত রাজাকারদের চেকপোস্টের সামনে পড়ে যায়। রাজাকাররা ওদের চ্যালেঞ্জ করে।
কোথা থেকে আসছ তোমরা? দাঁড়াও। দেখে তো এলাকার ছেলে মনে হয় না।
আমরা যেখান থেকে আসি না কেন, তোমাদের কী?
আবার বড় গলায় কথা বলা হচ্ছে। আমাদের পাড়ায় ঢুকেছ কেন? ঠিক করে বলো?
ওরে আমার কে রে। এদের কাছে আবার কৈফিয়ত দিতে হবে। যত্তসব।
আমরা তোমাদের সার্চ করব।
করেই দেখো। তোমাদেরও আমরা সার্চ করব।
কী, এত বড় কথা! ব্যাগে কী আছে, দেখা।
রাজাকাররা নজমুলকে জাপটে ধরলে শিবলি ওর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয়। নজরুল ইচ্ছে করে জোর খাঁটিয়ে জাপটাজাপটি করার ফাঁকে শিবলি ব্যাগ থেকে গ্রেনেড বের করে ছুড়ে মারে। গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলে রাজাকাররা হকচকিত বিমূঢ় হয়ে যায়। এই ফাঁকে ওরা নিজেদের মুক্ত করে। সঙ্গে সঙ্গে স্টেনগান বের করে গুলি করে। লুটিয়ে পড়ে দুজন রাজাকার। নিহত হয় কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন রিকশাওয়ালা।
ওরা আর একমুহূর্ত দাঁড়ায় না।
যে যে দিকে পারে সুযোগ বুঝে নিরাপদ জায়গায় চলে যায়। ওদের আর একসঙ্গে থাকা হয় না।
কয়েক ঘণ্টা পর তরিকুল আলমের বাড়িতে ফোন করে আকমল হোসেন জানতে পারেন যে অপারেশন সাকসেসফুল এবং ওরা নিরাপদে নিজ নিজ হাইডে চলে যেতে পেরেছে।
তিন দিন পর বাড়িতে আসে মারুফ।
আগস্টের এক বিকেল। ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ঝট গায়ে মাখে মেরিনা। আজ বাড়িতে ও একা। আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন জরুরি মিটিংয়ে আরেক দুর্গবাড়িতে গিয়েছেন। এলিফ্যান্ট রোডে। বলেছেন, সন্ধ্যার আগে ফিরবেন। নুসরাত ঢাকায় না থাকায় মেরিনা একা হয়ে গেছে। এখন এই নিশ্চুপ বাড়িটি ওর কাছে ভুতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে।
মারুফ ওর দরজায় এসে দাঁড়ালে চমকে ওঠে মেরিনা।
ভাইয়া, তুই। কবে এসেছিস? কী যে খুশি লাগছে। এবার বাড়িতে থাকবি?
তাই ভাবছি। বাবা-মা-বোনের আদর চাই।
অপারেশন নাই?
আছে। পাঁচ দিন থাকতে পারব বাড়িতে।
পাঁচ দিন। অনেক সময়। আমার কাছে এখন প্রতি সেকেন্ড এক দিন হয়ে যায়। উহ্, কী যে খুশি লাগছে!
তোর খুশি দেখে আমিও খুশি। আমারও ভীষণ ভালো লাগছে। কী করছিস একা একা?
বৃষ্টি দেখছি। তুই কাপড় চেঞ্জ করে নে, ভাইয়া। আমি তোর জন্য চানাশতার ব্যবস্থা করছি। তারপর দুজনে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখব।
তা-ই সই। আমি আসছি।
মারুফ নিজের ঘরে চলে গেলে মেরিনা বিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। জেবুন্নেসার কথা কি আজ ওকে বলবে? বুঝতে পারে না। বাবা-মাকে জিজ্ঞেস না করে বলা ঠিক হবে কি না, সেটাও চিন্তা করতে হবে। জেবুন্নেসার মৃত্যুর আঘাতে ও যদি দমে যায়? যদি মন খারাপ করে বসে থাকে? যদি…মেরিনা আর ভাবতে পারে না।
ও উঠে রান্নাঘরে যায়। চুলোয় চায়ের পানি বসায়। ফ্রিজ থেকে পাটিসাপটা পিঠা বের করে। মারুফ এই পিঠা খুব পছন্দ করে। ওর ভাগ্য, মায়ের হাতে বানানো পিঠা খাবে বলে ও আজ বাড়িতে এসেছে। মেরিনা এটুকু ভেবে খুশি হয়। দুঃখের খবর দেওয়ার আগে ওকে আনন্দ পেতে হবে। কতটা ও সইতে পারবে কে জানে! মেরিনা ট্রে-ভর্তি খাবার নিয়ে বারান্দার ছোট টেবিল গোছায়। চেয়ার আনে। হাসনাহেনা ফুলের ছোট একটি ডাল ভেঙে ছোট ফ্লাওয়ার ভাসে দিয়ে টেবিলে রাখে। ভাবে, আর কী করতে পারবে একজন যোদ্ধা ভাইয়ের জন্য। যার সামনে ও আজই এক দুঃখের কথা বলবে। বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। দুঃখের রূপকথা এখনই বলতে হবে। মেরিনা নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে জেবুন্নেসার চিঠিটা ড্রয়ার থেকে বের করে নিজের পড়ার টেবিলে চাপা দিয়ে রাখে।
বারান্দায় এসে ছোট টিপয়ের দিকে তাকিয়ে মারুফ বলে, বাহ্, সুন্দর আয়োজন তো। শান্ত এবং স্নিগ্ধ। একদম মনের মতো। পাটিসাপটা পিঠাও আছে দেখছি।
খাও। তুমি মায়ের ভাগ্যবান ছেলে। কত দিন পর বাড়ি এসে মায়ের বানানো পিঠে পেলে।
তুই কি আমাকে হিংসা করছিস?
মোটেই না। মায়ের ভালোবাসার আবার ভাগাভাগি কী! তুমি তো জানো, মা তোমার জন্য ফ্রিজে নানা খাবার রেডি রাখেন। বলেন, ও কোথায় কী খায় তার তো ঠিক নাই। বাড়িতে এসে যদি ঠিকমতো কিছু না পায়, তাহলে মন খারাপ করবে। আমাকে কিছু বলবে না, নিজে নিজে দুঃখ পাবে। থাকগে। তোমার কথা বলো। যুদ্ধের কথা।
ঢাকাকে ঘিরে গেরিলা তৎপরতা বেড়েছে। টের পাচ্ছিস না?