ঠিক বলেছেন। আমিও আপনার মতোই ভাবি।
গেরিলাযোদ্ধা পথচারীর সঙ্গে হাত মেলায়।
তারপর দ্রুত পায়ে হেঁটে মিশে যায় অন্ধকারে। রাস্তার মিটমিটে বাতি সে শরীর স্পর্শ করে না। যেন মানুষটাকে আড়ালে রাখতে চায়। ফুটপাতে হেঁটে যাওয়া লোকজনের পাশ কাটিয়ে এগোতে এগোতে যোদ্ধা ভাবে, দুর্গবাড়িতে অন্যরা অপেক্ষা করে আছে খবরের জন্য। ওদের কেউ উঠোনে পায়চারি করছে। কেউ হয়তো রাস্তার মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে। উৎকণ্ঠিত অপেক্ষা এখন। যোদ্ধা একটি রিকশা নিয়ে মহাখালী পার হয়ে ফার্মগেটের রাস্তায় ওঠে। ইচ্ছে হয় গলা ছেড়ে গান গাইতে। সেটা আর হয়ে ওঠে না। তার পরও দেশের জন্য একটি সাফল্য ওর জীবনের সবটুকু ছাপিয়ে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে। অল্পক্ষণে ও পৌঁছে যায় ফার্মগেটের দুর্গবাড়িতে।
আকমল হোসেন নিজের টেবিলে বসে পত্রিকার পাতা উল্টান। প্রথম খবর পড়েন, আজাদি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সিম্পোজিয়ামের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সভাটি হয়েছে। সভাপতিত্ব করেছেন পিডিপির নেতা নুরুল আমিন। জামায়াত নেতা গোলাম আযম আজাদির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, কখনো দেশ তার নিজের দেশের মানুষ দ্বারা শাসিত হলেই আজাদ হবে, আজাদির এই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়।
আগা সাদেক লেনে আবদুল মালেক গেটের উদ্বোধন করেন মতিউর রহমান নিজামী। খুলনার খালিশপুরের সভায় বক্তৃতা করেন সবুর খান। রাজশাহীতে আয়োজিত সেমিনারে বক্তৃতা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এম এ বারী—আজাদি দিবসের খবরাখবর নোট করে ডায়েরির পাতা বন্ধ করেন আকমল হোসেন।
তখন ফোন আসে ক্র্যাক প্লাটুনের হাসানের কাছ থেকে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বরে বলে, আঙ্কেল, আমাদের অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।
লাইন কেটে যায়।
আজ ওরা আইয়ুব গেটের কাছে একটি আর্মি কনভয়ে বিস্ফোরণ ঘটায়। মোহাম্মদপুর থেকে ওরা গাড়ি নিয়ে বের হয়। দেখতে পায়, মিরপুরের দিক থেকে আর্মি কনভয় আসছে। আইয়ুব গেটের কাছে পেট্রল পাম্পে ওরা পেট্রল নেওয়ার জন্য ঢোকে। পুরোটাই ছিল ছল করে ঢোকা এবং সময় কাটানো। গাড়ি থেকে নেমে জুয়েল রাস্তায় কয়েকটি মাইন পেতে দিয়ে আসে। কনভয়ের প্রথম দুটি গাড়ি মাইন চাপা না দিয়ে বেরিয়ে যায়। তৃতীয় গাড়ির চাকা মাইন চাপা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে গাড়ির চাকা বা হয়।
চারদিকে হইচই দৌড়াদৌড়ির মাঝে ওরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। ওদের লক্ষ্য, সুযোগ বুঝে আরও দু-চার জায়গায় অপারেশন চালানো। এভাবে ওরা শহরকে সন্ত্রস্ত রাখছে। পাকিস্তানিরা বলে, মুকুত। কেউ ধরা পড়লে চেঁচিয়ে বলে, মুকুত মিল গিয়া। মুকুতের ভয়ে পাকিস্তানি আর্মি যেন তটস্থ থাকে—এই ইচ্ছা নিয়ে ওরা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো আক্রমণ চালাচ্ছে।
পরদিন ফোন আসে। ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন আকমল হোসেন।
আঙ্কেল, আমরা বের হচ্ছি। দোয়া করবেন।
ওরা পাঁচজন বের হয়। লক্ষ্য দাউদ পেট্রলিয়াম লিমিটেডের পেট্রল পাম্প। টয়েনবি সার্কুলার রোড। বঙ্গভবনের পাশেই পেট্রল পাম্পটি।
ওরা কালো মুখোশ পরে ছিল। বের করে রাখা চোখজোড়া জ্বলছিল জ্বলজ্বল করে। ওরা একটি ফোক্স ওয়াগনে করে এসেছে। নেমেই ঝটপট ঘিরে ফেলে পাম্প অফিস। অফিসের পাহারায় থাকে একজন। কালো মুখোশ পরা গেরিলাদের দেখে পাম্পের অবাঙালি কর্মচারী দুজন ভয়ে চিৎকার করে উঠে বলে, ফ্যাক্টোমাস আ গিয়া। ছুটে পালিয়ে যায় ওরা।
নীলু হাসতে হাসতে বলে, দেখো দেখো, এই ব্যাটারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করবে।
আরেকজন বলে, চুনোপুঁটিদের কথা ছাড়।
ওরা তিনজন স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরক চার্জ বসায় মারুফ। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বসে আছে সামাদ। কাজ শেষে গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে দাউদাউ জ্বলে ওঠে পেট্রল পাম্প।
গাড়ি ছুটে যায় হাটখোলার দিকে।
ওরা জানে, আরেকদল গেরিলা পীরজঙ্গী মাজার পাওয়ার স্টেশন অপারেশনে যাবে। কমলাপুর রেলস্টেশনের উল্টো দিকে পাওয়ার স্টেশনটি। ওয়াপদার তৈরি। এই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় মতিঝিল কমার্শিয়াল এলাকা, মতিঝিল আবাসিক কলোনি, শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি এবং কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে।
আকমল হোসেন ঘড়ি দেখেন এবং নিজের আঁকা ম্যাপের ওপর ঝুঁকে থাকেন। লাল কালি দিয়ে রাস্তা আঁকা আছে। গাড়ি যাচ্ছে এমন করে ছবি এঁকেছেন, যেন তিনি বুঝতে পারেন গাড়ি কোন রাস্তা দিয়ে ছুটছে। তাকিয়ে থাকেন একদৃষ্টে। ভাবেন, মনোযোগ ছুটে যেতে দেওয়া যাবে না।
পাশে বসে আছে আয়শা ও মেরিনা। তারাও খুব উদ্বিগ্ন। এমন পরিস্থিতিতে আয়শা সব সময় আঙুল মটকান। আর মেরিনা দাঁতে নখ কাটে। আকমল হোসেন নিজে একদম নিশ্চুপ হয়ে যান, যেন তাঁর সামনে কথা বলার মতো পরিস্থিতি থাকে না। মনে করেন, গুটিয়ে থাকাই এ সময়ের কথা। নানাভাবে তার প্রকাশ ঘটে। ঘরে দিনের আলোর আলো-আঁধারি। জানালায় মোটা কাপড়ের পর্দা টানা। দুপাশের দরজা মুখে মুখে লাগানো। ড্রয়িংরুমের দেয়ালে ছোটোছুটি করে একটা টিকটিকি।
পাওয়ার স্টেশন অপারেশনের জন্য দশ পাউন্ড পিকে দিয়ে তৈরি করা হয় দুটো ইমপ্রোভাইজড গ্রেনেড। সঙ্গে দেওয়া হয় দুটো নন-ইলেকট্রিক ডেটোনেটর-২৭ এবং প্রতিটিতে দেড় মিনিটের ফিউজওয়্যার। সঙ্গে আছে স্টেনগান ও গ্রেনেড-৩৬।