হেলাল চুটকি কেটে বলে, কাল ওরা উদ্যাপন করবে আজাদি দিবস।
আর আমরা করব আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দিবস। আমাদের লাল-সবুজ পতাকা ঢাকার আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বলব, দেখো আমাদের। আমরা তোমাদের মাথার ওপর উড়ছি। বাতাসের বেগে ছুটছি। আমাদের পথ আটকাবে কে?
হা হা করে হাসে সবাই।
ওরা আমাদের কাজ দেখেও দেখতে পায় না রে।
ওদের কি দেখার চোখ আছে নাকি? ওরা তো অন্ধ। যেটুকু দেখে ওটুকু ওদের ক্ষমতার জমিন। বাকিটা সাফা। অন্ধের না দেখা।
রাজাকারগুলোও এমন হয়েছে। সব জাউরা। পা চাটাই শিখেছে। স্বাধীনতার মূল্য বোঝেনি।
চীন আর আমেরিকার মতো বড় দেশ দুটোও যা করছে, তাতে মনে হয়, ওরা কখনো স্বাধীনতার জন্য জীবন দেয়নি।
ওরা তো ঘরে বসে পেয়েছে। ভাবখানা এমন।
কাজ করতে করতে ওরা হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে, বিগ পাওয়ার। বিগ পাওয়ার হলে মাথাটা বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে হয়। এটা যে ওরা কোথায় থেকে শিখল কে জানে! আমরা বিগ পাওয়ার হলে আমাদের এমন ভীমরতি হবে না।
ঠিক বলেছিস। হা হা হাসিতে অন্ধকার তাড়ায় ওরা।
শেষ রাতে ওদের ঘুম পায়। পরদিন সারা দিনের অপেক্ষা। চৌদ্দ তারিখে রাতের আকাশে উড়ে যায় বাংলাদেশের পতাকা। গ্যাস বেলুনের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া পতাকায় চাঁদের আলো ছড়ায়।
আকমল হোসেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছাদে ওঠেন। সন্ধ্যার আঁধার ঘন হলে তাঁর বাড়ির ছাদ থেকে পতাকা নিয়ে উড়ে যায় পাঁচটি গ্যাস বেলুন। মেরিনা হাততালি দিতে চেয়েছিল। আয়শা খাতুন ওর হাত চেপে ধরে বলেন, এখন উচ্ছ্বাসের সময় না। উচ্ছ্বাসের দিন সামনে।
মেরিনা নিজেকে সামলায়। ভাবে, এত পতাকা সেলাই করে মরে গেলে ও কি শহীদ হবে? শহীদের সংজ্ঞা কী? মেরিনার ভাবনায় শব্দটি তোলপাড় করে। এই মুহূর্তে মাকে এই সব কথা জিজ্ঞেস করা যাবে না। বাবাকেও না। আকাশে উড়ে যাওয়া পতাকার দিকে তাকিয়ে ওর ভীষণ মন খারাপ হয়। গতকাল নুসরাত বলেছে, নওশীন খুবই বাড়াবাড়ি করছে। রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না। তাই আমরা চলে যাচ্ছি। তোর সঙ্গে কবে আবার দেখা হবে, জানি না। জয় বাংলা, মেরিনা।
জয় বাংলা।
মেরিনা টেলিফোনে চেঁচিয়ে জয় বাংলা বলেছিল। এখন খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে পারছে না। বাড়িটা নিয়ে চিন্তিত সবাই। এই মুহূর্তে কেউ কোনো কথা বলছে না। মন্টুর মা একটি পাটি এনে বিছিয়ে দিয়েছে। সবাই বসে আছে। নিচে বাড়ির সব বাতি বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ঘরেও তালা, গেটেও। কেউ এসে খোঁজ করলে বুঝবে বাড়িতে কেউ নেই। আর মুক্তিযোদ্ধারা খুঁজতে এলে ভাববে দুর্গবাড়ি। পরিবারের সবাই আজ ছাদে। আকাশে পতাকা-বেলুন ওড়াচ্ছে। ওরা কেউ এলে অপেক্ষা করবে। নইলে ঘুরেফিরে আবার আসবে। বলবে, জয় বাংলা মামণি, মিষ্টি খাব। আজ উৎসবের দিন।
পরদিন লালবাগের শান্তি কমিটির নেতা ওবায়দুল্লাহর পিছু নেয় ক্র্যাক প্লাটুনের দুজন। সোহেল আর শিহাব। দুজনই মোটরসাইকেলের আরোহী। ওবায়দুল্লাহও মোটরসাইকেলে যাচ্ছে। বকশীবাজারের কাছে রিভলবারের গুলিতে বিদ্ধ করা হয় তাকে। মোটরসাইকেল সামলাতে না পারলে সেটা গিয়ে আছড়ে পড়ে রাস্তার পাশের একটি বাড়ির দেয়ালের ওপর। ওরা দুজন মোটরসাইকেল নিয়ে উধাও হয়ে যায়। কেউ কিছু বোঝার আগেই ওরা চলে যায় নিরাপদ দূরত্বে।
সেই সন্ধ্যায় ফার্মগেট এলাকার দুর্গবাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় একজন। যাবে বনানী। একসময়কার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের বাড়ি সেখানে। ক্ষমতার সুতা ধরে বনানীতে বড় একটি বাড়ির মালিক হয়েছিলেন তিনি। প্লটটা অনেক বড়। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের দখলে নেওয়া। শাসনকালের পুরো সময় নিজের দেশের মানুষকে পীড়িত করেছেন অনবরত। আর স্বার্থ উদ্ধারের জন্য পা চেটেছেন প্রভুদের। লজ্জা-শরমের ধার ধারেননি লোকটি। মানুষ কী করে এমন নির্লজ্জভাবে নিজের স্বার্থ পূরণের জায়গাটি ভরাতে পারে? লোকটি আত্মসম্মান শব্দের মানেই জানেন না।
দুর্গবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা একজন বনানীর বাড়ির ড্রয়িংরুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। পেছনের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকেছে মুক্তিযোদ্ধা। দরজার দিকেই মুখ করে বসে আছেন মোনায়েম খান। চারপাশে বেশ কয়েকজন লোক। চামচা গোছের হবে। যারা তার কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে পেট ফুলিয়েছে। এখন স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করছে।
লুঙ্গি এবং হাওয়াই শার্ট পরা গেরিলা স্টেনগান তাক করে ফায়ার করে। গুলি তার তলপেট ভেদ করে সোফা ভেদ করে দেয়ালে গিয়ে লাগে। অন্যদের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে বেরিয়ে যায় একজন গেরিলা। মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। প্রধান সড়কে তখনো গাড়ি ও মানুষ। ফুটপাত ধরে হেঁটে যাওয়া মানুষের ভিড়ে মিলেমিশে এক হয়ে গেলে একজন পথচারী জিজ্ঞেস করে, একটুক্ষণ আগে গুলির শব্দ পেলাম। কারা হতে পারে? কোথায় হতে পারে?
আমি কী করে জানব! আমি তো আর কাউকে দেখিনি।
আপনি গুলির শব্দ পাননি?
পেয়েছি। আপনারা সবাই পেলে আমি পাব না কেন?
কিছু ভাবেননি? কারা এটা করতে পারে?
ভাবব কী, পালাতে পারলে বাঁচি। মুক্তিযোদ্ধাদের দাপট যে কত বেড়েছে, তা কি আর বলে শেষ করা যায়। ছোটখাটো গুলির শব্দ ওদের কাছ থেকেই আসবে। আর্মি হলে তো চারদিক ফাটাবে।
ওরা আছে বলে তো ধড়ে প্রাণ ফিরে পাই। নইলে আর্মি আর রাজাকারদের অত্যাচারে দেশটা ছারখার হয়ে যেত। ওরা আছে বলেই তো স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাই না। স্বাধীনতার অপেক্ষায় থাকি।