আকমল হোসেন ম্যাপের ওপর মাথা নামিয়ে রাখেন। চোখ সরাতে পারছেন না। মাথাও তুলতে পারছেন না। তাঁর মনে হয়, তিনি ফিক্সড হয়ে গেছেন অপারেশন ম্যাপের ওপর। বুঝতে চাচ্ছেন, এখন ওরা কোথায়। ঘড়ি দেখে সময় মেলালেন। ধরে নিলেন, ওরা এখন প্লেটার চার্জ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানেন প্লেটারটি ওজনে ভারী এবং দেখতে খানিকটা অন্য রকম। প্রচলিত আকারের নয়। যে কেউ বলবে, অদ্ভুত এই জিনিসটা কী।
সন্ধ্যা বলে রাস্তা বেশ ফাঁকা। লোক চলাচল কম। রিকশা আছে। যারা হাঁটছে তারা বেশ দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছে। শাহজাহান আর জলিল বাক্সটি নিয়ে দ্রুত পায়ে যায়। পাহারারত পুলিশের সন্দেহ হয়। এগিয়ে আসতে থাকে ওদের দিকে। ওরা বুঝতে পারে যে এটা নিয়ে কথা-কাটাকাটি হলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় আছে। ওরা বাক্সটি এক জায়গায় রেখে খানিকটা দূরে সরে যায়।
পুলিশ কিছু অনুমান করতে না পেরে পিছু হটে নিজের জায়গায় যায়। ওদেরকে একটু বিভ্রান্ত মনে হয়। বোঝা না-বোঝার দোলাচলে ওরা নিজের অবস্থান নেয়। চারদিকে তাকায়।
মুহূর্ত সময় মাত্র। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় মনিরুল। বুঝতে পারে যে দেরি করলে সময় নষ্ট হবে। ও একটি সিগারেট জ্বালিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়। কয়েকজন পথচারী অদ্ভুত বাক্সটি দেখে দাঁড়িয়েছে। নানাজনে নানা কথা বলছে। মনিরুল সিগারেটে টান দিয়ে এগিয়ে যায়। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে প্লেটারের চার্জকে ইগনাইট করে। তারপর নিমেষে সরে পড়ে। ওর এই কাজটুকু দেখে পথচারীসহ এগিয়ে আসা পুলিশের মনে হয় কিছু একটা ঘটবে। ওরা ঝটিতি পিছু হটে যায়। অল্পক্ষণেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে হ্যান্ড-গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়।
চোখের পলকে জনশূন্য হয়ে যায় এলাকা।
গেরিলারা নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে ফোন দেয় আকমল হোসেনকে। উজ্জ্বল মুখে তিনি বলেন, কনগ্রাচুলেশনস। ফোন কেটে দেন।
আয়শা হেসে বলেন, খবর পেয়ে গেছি। তোমাকেও অভিনন্দন। যাই, পতাকা বানানোর কাজটা শেষ করি।
হ্যাঁ, দ্রুত করা। সময় বেশি নেই।
বলতে বলতে তিনি নিজের পড়ার টেবিলে এসে কাগজ খুলে বসেন। প্রতিদিনের কাগজ না পড়লে তিনি একটুও স্বস্তি পান না।
প্রথম যে খবরে চোখ যায়, তা টিক্কা খানের নির্দেশ। সামরিক দপ্তরের এক নোটিশে যোলোজন নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সামরিক কর্তৃপক্ষের সামনে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাউকে কাউকে নাটোরের ২ নম্বর সেক্টরের উপসামরিক আইন প্রশাসকের সামনে হাজির হতে বলা হয়েছে। কাউকে কাউকে যশোরের ৩ নম্বর সেক্টরের উপসামরিক প্রশাসকের সামনে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আকমল হোসেন নামগুলো লিখে রাখেন। কেউই দেশে নেই। সবাই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়া চলে গেছে। তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রবাসী সরকারকে সহযোগিতা দিচ্ছে। সরকার শক্ত হাতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। এখন তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার হবে। ইন্ডিয়া বসে কেউ যদি এমন খবর পায়, তাহলে তারা বুড়ো আঙুল দেখাবে।
আকমল হোসেন কাউন্সিল মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আবুল কাসেমের বিবৃতি ডায়েরিতে তুলে রাখেন—৫৪ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে। মার্চ থেকে এই সমাজবিরোধীরা চূড়ান্ত আঘাত হানে। সম্মিলিতভাবে এসব দুষ্কৃতিকারীকে প্রতিহত করে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ডায়েরির পাতা বন্ধ করলেন তিনি।
খুললেন আরেকটি পত্রিকা। পড়লেন খবর—নিয়াজি রংপুর ও বগুড়া সফরে গিয়েছে। রংপুরের শান্তি কমিটি, রাজাকার ও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় বলেন, আবার তিনি ডায়েরির পাতা উল্টালেন, লিখলেন নিয়াজির বক্তৃতার অংশ-ভারত কোনো দিনই পাকিস্তানের বন্ধু নয়। বাঙালির প্রতি লোক দেখানো সহানুভূতির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই অঞ্চল কুক্ষিগত করা। তাই তারা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সমাজবিরোধীদের সাহায্য করছে। কিন্তু আমাদের বীর সেনাবাহিনী এই অপপ্রয়াসকে কোনো দিন সফল হতে দেবে না।
চোখ গেল আরেকটি খবরের ওপর। ৮৮ নম্বর সামরিক আদেশ জারি হয়েছে। এই আদেশবলে আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসক এক বা একাধিক ফৌজদারি আদালত গঠনের ক্ষমতা লাভ করে।
আকমল হোসেন সব কাগজ ভাঁজ করে সরিয়ে রাখলেন। ভাবেন, পাকিস্তানের তেইশ বছরে এ দেশের মানুষ কেন্দ্রীয় সরকারের নানা নিপীড়ন সহ্য করেছে। এসব দমন-পীড়নে মানুষের আর কিছু যায় আসে না। মানুষ এখন যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চলেছে। পেছন ফিরে তাকাবে না। মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের বিচার করবে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে স্বাধীন দেশেও তোমাদের বিচার হবে। তৈরি হও।
আকমল হোসেন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন।
কয়দিন পরই প্রতিটি বাড়ি থেকে তৈরি করা পতাকাগুলো চলে যায় ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোডের বাড়িতে। সেখানে বসে পরিকল্পনা করা হয়। ঢাকার বেশ কয়েকটি বাড়ি থেকে পতাকা ওড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। চুনু ধোলাইখাল এলাকা থেকে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে আসে ধানমন্ডির বাড়িতে। কারও চোখে ঘুম নেই। সবাই ব্যস্ত থাকে বেলুনে গ্যাস ভরার জন্য। রাত কেটে যায় নানা গল্পে। একজন একটা বলে তো আরেকজন আরেকটা। রাত ওদের কাছে রাত মনে হয় না। দিনরাত সমান।