নুসরাতের আব্বা-আম্মা…
তাঁদের জীবন তো অতিষ্ঠ। নুসরাতের বাবা নাকি ওকে ছাতা দিয়ে তাড়া করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। কিন্তু সবাই খুব তটস্থ। ছেলেটা কী ঘটাবে চিন্তা করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। চাচা বললেন, ছেলেটি যদি আরেকবার বিরক্ত করতে আসে, তবে বাড়িতে তালা দিয়ে গ্রামে চলে যাবেন।
আকমল হোসেন ভাত খেতে পারেন না। হাত থেমে থাকে প্লেটের ওপর। আয়শা মৃদুস্বরে বলেন, তুমি ভাত খাও। সবকিছু সহ্য করতে হবে। ভাতও খেতে হবে।
আকমল হোসেন প্লেটের ভাত রেখে উঠতে গেলে মেরিনা তড়িঘড়ি বলে, আব্বা, আমার কথা তো শেষ হয়নি।
বলো, মা। আকমল হোসেন এক গ্লাস পানি শেষ করেন। আকস্মিকভাবে মনে করলেন, তার বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তিনি মরুভূমির মতো বিরান জনপদে একা একা পানির জন্য ঘুরছেন।
আব্বা, আপনি ভাত শেষ করেন। আমিও খেয়ে নিই।
আকমল হোসেন খুব বিষণ্ণ বোধ করেন। তার পরও খেতে শুরু করলে আয়শা তার প্লেটে পাবদা মাছ তুলে দেন।
মাছটা ভাতের মাঝখানে টেনে এনে বলেন, মারুফ পাবদা মাছ খুব ভালোবাসে।
আব্বা, এভাবে মনে করে মন খারাপ করবেন না। পাবদা মাছটা আপনি আয়েশ করে খান। এ বাড়িতে সবাই পাবদা মাছ ভালোবাসে।
মাছ দিয়ে এক লোকমা ভাত মুখে পুরে বলেন, গত সাত দিন ছেলেটার ফোন পাইনি।
ও ফোন করেছিল। আপনি বাইরে ছিলেন, আম্মা অসুস্থ। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে।
আমাদের তো বলোনি, মা।
ইচ্ছে করে বলিনি। ভাইয়া মনে করছে এ বাড়িতে আমার আর থাকা ঠিক হবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের আসা-যাওয়ায় বাড়িটা আশপাশের লোকদের নজরে পড়তে পারে বলে ভাইয়া মনে করছে। সে জন্য আমাদের সতর্ক হতে হবে। নওশীনের এই হুমকি শুনে আমার মেজাজ আর ঠিক নেই।
মেরিনা থেমে এক গ্রাস ভাত খায়। পানিও।
ও কি তোমাকে ত্রিপুরা নিতে চায়?
হ্যাঁ, আব্বা। বিশ্রামগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে হাসপাতাল করা হয়েছে, ওখানে নার্স হিসেবে কাজ করব। ঢাকা থেকে বেশ কয়েকজন মেয়ে গেছে।
আকমল হোসেন চিন্তিত মুখে ভাতের প্লেটের ওপর মুখ নামান। আকস্মিকভাবে গবগবিয়ে তিন-চার গ্রাস ভাত খেয়ে ফেলেন। আয়শা খাতুন পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলেন, পানি খাও।
আকমল হোসেন পানির গ্লাস নেন। হাতে নিয়ে আবার টেবিলে রাখেন। বুঝতে পারেন, পানি খাওয়ার ইচ্ছে তার নেই।
আব্বা, আমার আরেকটা কথা আছে।
আয়শা ধমকের সুরে বলেন, এসব কথা এখন বন্ধ রাখ, মেরিনা। খাওয়ার পরে নিরিবিলি এসব কথা বলা যাবে। কী করা হবে, সেটাও আমরা চিন্তা করতে পারব। তোমার কোনো ভাবনা থাকলে তা-ও আমাদের জানাবে।
এবার অন্য কথা, আম্মা। পতাকার কথা।
আকমল হোসেন চোখ তুলে সরাসরি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, পতাকার কথা কী?
আমার আরও কিছু কাপড় দরকার হবে, আব্বা।
আগে যেভাবে কিনেছিলাম, সেভাবে?
আগের মতো টুকরো টুকরো আনতে হবে। সবুজ লুঙ্গি, লালসালু আর হলুদ কাপড়।
বুঝেছি। একসঙ্গে আনলে ওরা সন্দেহ করবে। তুমি চিন্তা কোরো না, মা। আমি বিকেলেই বের হব। কতগুলো বানাবে ঠিক করেছ?
পাঁচ শ। দেখা যাক কতগুলো পারি। মানচিত্রটা কেটে সেলাই করতে সময় লাগে। তবে সবাই মিলে তিন শ তো হবেই।
ভেরি গুড। আমি উঠছি।
তোমার আব্বা কাজ পেলে সবচেয়ে খুশি হয়। তাই বলে ভেবো না যে মাছ-তরকারি কিনতে বললে খুশি হয়।
মেরিনা হাসতে হাসতে বলে, তা আমি জানি, আম্মা। যুদ্ধ আব্বাকে নতুন মানুষ করেছে।
আমাদেরকেও। আয়শা জোরের সঙ্গে বলেন।
হ্যাঁ, আমাদেরকেও নতুন মানুষ করেছে, আম্মা।
যেতে যেতে আকমল হোসেন ফিরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, পতাকা ওড়ানোর সময় মারুফ কি ঢাকায় থাকবে?
ও আসবে বলেছে। তবে কবে আসবে, তা নিশ্চিত নয়।
বাড়িতে কি আসবে?
তা কিছু বলেনি।
আচ্ছা, দেখা যাক।
আকমল হোসেন হাত ধোয়ার জন্য বাথরুমে যান। মেরিনা প্লেটের ভাতটুকু শেষ করে বলে, ভাইয়া বলেছে, মাকেও খালাদের কারও বাড়িতে সরিয়ে দেব।
তোর বাবা কি একা থাকবে?
আলতাফ ভাই থাকবে।
না, তা হবে না। তোর বাবাকে একা রেখে আমি কোথাও যাব না। ছাড়তে হলে সবাই এই বাড়ি ছাড়ব।
এই অনিশ্চিত সময়ের সিদ্ধান্ত এক রকমই হওয়া দরকার। আমরা এখন থেকেই ভাবব, মা।
মেরিনা প্লেট-বাটি-গ্লাস গোছাতে থাকে। মন্টুর মা এসে নিয়ে যায়। দুপুর গড়িয়ে যায়। বিকেল সূচিত হয় মাত্র, তখন আকমল হোসেন পতাকার জন্য কাপড় কিনতে বের হন।
১০. আজ স্টেট ব্যাংকে অপারেশন
আজ স্টেট ব্যাংকে অপারেশন। ক্র্যাক প্লাটুনের পাঁচজন সদস্য তৈরি। ব্যাংকের একজন পিয়নের সাহায্যে বেলা বারোটার দিকে রেকির কাজ শেষ করা হয়েছে। অপারেশনের সময় ছয়টা।
এদের কাছে আছে স্টেনগান ও হ্যান্ড-গ্রেনেড। বিস্ফোরণের জন্য তৈরি করা হয়েছে প্লেটার চার্জ। ওর ভেতরে আছে কুড়ি পাউন্ড পিকে এবং সাত সের স্প্লিন্টার।
প্লেটারটি বানানোর খরচ দিয়েছেন আকমল হোসেন। এখন ঘড়ি ধরে বসে আছেন। তিনি জানেন, তার সামনে এখন একেকটি মুহূর্ত অনন্তকাল। ড্রয়িংরুমে মৃদু আলো জ্বলছে। মেরিনা ওর নিজের ঘরে। পতাকা বানানোতে ব্যস্ত। আয়শা খাতুন সোয়েটার বোনা বাদ দিয়ে পতাকা সেলাইয়ে হাত লাগিয়েছেন।
আকমল হোসেনের সামনে পরিকল্পনার কাগজ। তিনি খুঁটিয়ে দেখছেন। বিস্ফোরক প্লেটারটি ব্যাংকের উত্তর দিকের গেটে পুলিশদের বাংকারের পাশে বসানো হবে। হাতের আড়ালে স্টেনগান লুকিয়ে মনিরুল কাভার দেবে। গ্লাক্সো ভবনের কাছে গ্রেনেড নিয়ে তৈরি থাকবে মাসুদ ও জিনাত। ওরা রিকশায় করে স্টেট ব্যাংক ভবনের গেটের কাছে আসবে।