কী হলো? এত সময় নিয়ে গোসল করছ কেন? তুমি সকালেও গোসল করেছ।
আকমল হোসেন ট্যাপ বন্ধ করেন। সব কাজের ব্যাখ্যা সব সময় হয় না। যে আচরণটি করে, তার ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। যদি সেই আচরণটি খুবই ব্যক্তিগত হয় ও অন্যকে বিব্রত না করে। এমন এক সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়ে তিনি মনে করেন, সব কেনর উত্তর খুঁজতে গেলে অকারণ আনন্দ লাভ কীভাবে হবে? অন্যরা যখন আরেকজনের আচরণের কারণ জানতে চায় সেটার উত্তর না দেওয়াই ভালো। তিনি গা মুছে দরজা খুললেন।
কী হয়েছে? আয়শা ভুরু কুঁচকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন।
কিছু হয়নি তো। আকমল হোসেন নির্বিকার কণ্ঠে হাত নাড়েন। ভাবটা এমন যে, দেরি করেছি তো কী হয়েছে? গোসল করব তার জন্য তোমাকে জবাব দিতে হবে। কেন, আশা? আমি তোমাকে ভালোবাসি। দুজনে ছাব্বিশ বছর সংসার করেছি। সুখ-দুঃখে ভালোই তো দিন কাটিয়েছি। তিনি আয়শার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলেন।
আয়শা তাঁর হাসির অর্থ বুঝতে পারেন না। অবাক হয়ে বলেন, ছেলেমানুষি করলে?
মনে করো তা-ই। আকমল হোসেনের কণ্ঠ আগের মতোই নির্বিকার।
কার সঙ্গে করলে?
আকমল হোসেন জোরে হেসে ওঠেন, যেন নদীর কল্লোল তাঁর শরীরজুড়ে ছলছল করছে। সে শব্দ আয়শা খাতুনের কানে এসেও পৌঁছায়। তার ভালোই লাগে।
তিনি কৌতুকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, নদীর সঙ্গে। তিতাস নদী।
আয়শা নিজেও হাসিমুখে বলেন, কী যে পাগলামি করো। চলো, খাবে। মেরিনা বসে আছে। মেয়েটা বলছিল ওর খিদে পেয়েছে।
তুমি যাও। আমি আসছি। মাথা আঁচড়ে নিই। আবার চুল থেকে পানি পড়তে দেখলে মেয়েটা আবার বলবে, আব্বা ডাইনিং টেবিলের ম্যানারই শিখল না।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবার চুল নিয়ে ছেলেমানুষি করবে না তো? আমার আশঙ্কা হচ্ছে।
করতেও পারি। তোমার আশঙ্কা ঠিকই আছে। আজ আমি মনে মনে ছেলেমানুষি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বেশ করেছ। এবার কোন নদী?
নদী না। এবার গাছ। ঝকড়া নিমগাছ। একটু আগে দেখে এসেছি। এতই ঝকড়া যে ওটার নিচে দাঁড়ালে আকাশ দেখা যায় না। আমি ফার্মগেট গেলে ওই গাছের নিচে দাঁড়াই। দু-পাচটা নিম ফল কুড়িয়ে নিই। আজও গাছটা ভালোই মিলিয়েছ।
তোমার মাথার ঝাকড়া চুলের সঙ্গে মিলবে। যুদ্ধের সময়ও তোমার মাথা থেকে গাছ আর নদী সরে যায় না। পায়রা বাপু।
আমি গেলাম।
মাকে টেবিলে দেখে মেরিনা ভুরু কোঁচকায়—আব্বা, গোসল হয়নি? আজ কেন আব্বা এত সময় লাগিয়ে গোসল করছেন? আব্বার কী হয়েছে?
তোমার আব্বার কিছুই হয়নি। বরং আমি দেখে এসেছি যে বেশ আনন্দে আছেন। বলা যায়, তোমার আব্বা খেলছেন।
মানে? কী খেলা খেলছেন? কার সঙ্গেই বা খেলছেন?
শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে খেলেছেন তিতাস নদীর সঙ্গে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে খেলছেন ফার্মগেটের নিমগাছের সঙ্গে।
বুঝেছি। আব্বা আনন্দে আছেন। স্টেট ব্যাংক অপারেশন সাকসেসফুল হবে। ওয়াও-ও-ও-
মেরিনা উচ্ছাসে হইচই করে ওঠে। ভাতের থালায় চামচ দিয়ে টুংটুং শব্দ করে বলে, জয় বাংলা।
আকমল হোসেন ততক্ষণে টেবিলের সামনে আসেন। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়েছেন। নীল রঙের পাঞ্জাবি পরেছেন। যদিও লুঙ্গি পরা এবং পায়ে স্যান্ডেল, তার পরও তাকে খুব স্মার্ট দেখাচ্ছে। আয়শা তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকান এবং বুকের ভেতরে টুং করে ওঠে। তিনি প্লেটে ভাত দেওয়ার জন্য চামচের দিকে হাত বাড়ান। তাঁর দৃষ্টি মানুষের ওপর থেকে বস্তুর ওপরে আসে।
মেরিনা কলকল করে বলে, কনগ্রাচুলেশনস, আব্বা।
আকমল হোসেন চেয়ার টেনে বসে নিজের প্লেটে হাত রাখেন। পরে মেরিনার দিকে ঘুরে বলেন, বলল, কী করেছি? সাফল্য কোথায়?
আপনি আনন্দে আছেন, একটি সাকসেসফুল অপারেশনের জন্য। সাফল্য আপনার দোরগোড়ায়, আব্বা।
ঠিক বলেছ। কনগ্রাচুলেশনস এ বাড়ির সবাইকে। দাও প্লেটভর্তি ভাত দাও। পেট পুরে খাই।
আয়শা মৃদু হেসে বলেন, কতটুকু খেতে পারবে তা তো আমি জানি। নিজেই তো বলো, যতকাল বেঁচেছ তাতে অনেক খাওয়া হয়েছে। এবার খাওয়ার পরিমাণ কমাতে হবে। আমি তো দেখেছি কমিয়েছ।
আকমল হোসেন মৃদু হাসেন। আয়শার কথার জবাব দেন না। কত কথাই তো জমে আছে বুকের ভেতরে। সব কথা কি আয়শাকে বলা হয়েছে? না, হয়নি। যত দিন বাঁচবেন, তত দিন বলেও শেষ করতে পারবেন না। কিছু কথা অনুক্তই থাক।
আকমল হোসেনের প্লেটে ভাত দিলে তিনি প্রথমে লালশাক ভাজি দিয়ে খেতে শুরু করেন। দুলোকমা খেয়েই বলেন, এবার তোমার কথা বলো, মা।
আপনি তো জানেন, আব্বা, নুসরাতের ভাই রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ট্রেনিং শেষ করেছে। ওর অ্যাটিচুড খুবই আক্রমণাত্মক, আব্বা।
আকমল হোসেন খাওয়া বন্ধ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
মেরিনা আবার বলতে থাকে, গেরিলাযোদ্ধারা তো ঠিক করেছে, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে গ্যাস বেলুনে বেঁধে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হবে। আমি, নুসরাত, হাসনা, ঝর্না পতাকা বানানোর দায়িত্ব নিয়েছি। নওশীন একদিন হঠাৎ করে বাড়িতে এসে নুসরাতকে পতাকা সেলাই করতে দেখে। কাপড়গুলো মেঝেতে টেনে ফেলে পায়ের নিচে রেখে দাঁড়ায়। তারপর ওকে শাসিয়ে বলে, বেশি বাড়াবাড়ি করলে নুসরাতকে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে দিয়ে আসবে।
কী? কী বললে?
আব্বা, ও এত দূর বেড়েছে। নুসরাত আমাকে কাঁদতে কাঁদতে এসব বলেছে। আরও বলেছে, মেরিনা, ও বোধ হয় আমার আপন ভাই না। আপন ভাই হলে ও আমাকে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে দিয়ে আসার কথা বলতে পারত না। মা গো, কী করে ও এসব কথা মুখে আনল!