আঙ্কেল, এটা মজার খেলা। আমিও আপনার সঙ্গে খেলব।
এসো। আমরা পাঁচ মিনিট খেলব। বেশি সময় না।
পাঁচ মিনিট আমার জন্য অনেক সময়, আঙ্কেল।
স্বপন লজ্জাবতী ঝোপের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে বেগুনি ফুল বুজিয়ে দেয়। তারপর ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চলেন, আঙ্কেল।
আকমল হোসেন ঘাসে পা মুছে স্যান্ডেলে পা ঢোকান। ভাবেন, এখানে আশরাফকে নিয়ে আসতে হবে। ও ঘাসের পরশে স্নিগ্ধ হয়ে বলবে, এই দেশটা এত সুন্দর কেন? চলো, দুজনে পায়ে হেঁটে দেশটা ঘুরে বেড়াই।
আকমল হোসেন গেরিলাদের সঙ্গে বসে ওদের পরিকল্পনার কথা জানতে চান। তখন একটি কাগজ দেখছিল সবাই মিলে। একটি টিপয়ের ওপরে রাখা কাগজের চারপাশে ওরা বসে আছে। কেউ হাটু মুড়ে, কেউ পা গুটিয়ে। ওদের মনোযোগ গভীর। আকমল হোসেন ওদের সঙ্গে বসে পড়েন। ওরা তার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দেয়।
হাবীব বলে, আমরা স্টেট ব্যাংকের এই ম্যাপটি করেছি, আঙ্কেল। আপনি দেখেন। আমাদের নেক্সট অপারেশন এখানে হবে।
স্টেট ব্যাংক তো খুব ইম্পর্ট্যান্ট ভবন। প্রতিটি গেটে কড়া পাহারা থাকে। ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করতে হবে।
আমরা ঠিক করেছি পাঁচজন যাব। সিরাজ এর মধ্যে রেকি করে এসেছে। ঘটনার দিন দুলাল যাবে রেকি করতে।
এই কাগজটা দেখুন, চাচা। এই যে গেট। কতক্ষণ পরে পরে যে পাহারার বদল হয়, সেটা আমরা জানি। আমরা ঠিক করেছি, পাহারা বদলের সময়টা কাজে লাগাব। রদবদলের সময় ওরা কিছুটা অন্যমনস্ক থাকবে, ফুল অ্যাটেনশন দেবে না।
আকমল হোসেন চিন্তিত মুখে বলেন, ওদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দেওয়া হয়েছে। বিপজ্জনক অস্ত্র।
তা আমরা জানি। এটাও দেখে এসেছি যে ব্যাংকের একপাশের বাংকারে পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ পাহারায় থাকে। ব্যাংক ভবনের দেয়াল ঘেঁষে আছে ওই সব পুলিশের দুটো ক্যাম্প।
আকমল হোসেন মনোযোগ দিয়ে ওদের আঁকা ম্যাপটা দেখেন। দেখে খুশি হন। ওরা ভাললা পরিকল্পনা করেছে।
আমরা অপারেশন এই সময়ে করার জন্য একটি কারণ বেছে নিয়েছি।
আকমল হোসেন মৃদু হেসে বলেন, দুররানি আসবে এ জন্য?
ঠিক, চাচা, একদম ঠিক। একটা হাড় বদমাশ লোক। পিআইএতে বাঙালিদের দমন-পীড়নের একজন বড় হোতা। তাকে আবার স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের গভর্নর করা হয়েছে।
আমি জানি, বাবারা। তোমরা ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। ও ঢাকায় আসছে চার দিনের এক সম্মেলন উদ্বোধন করতে। সম্মেলনে অংশ নেবে ব্যাংক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা। সব তথ্যই খবরের কাগজ থেকে পাওয়া। এ সময়ে একটা অপারেশন করতে পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান বুঝবে ওরা। দুররানিকেও বোঝানো দরকার। তারপর করাচিতে ফিরে
প্রভুদের বলবে ঢাকার ঘটনা।
ছেলেদের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আকমল হোসেন ভাবেন, ওদের মুখের দিকে তাকালে নিজের বয়স কমে যায়। তিনি ওদের বলেন, তোমাদের জন্য যে জিলাপি আর বাখরখানি এনেছি, তোমরা তা খাও।
ছেলেরা প্যাকেট খুলে ওগুলো বের করে। হুটোপুটি করে খায়। তাঁর দিকে এগিয়ে দিলে তিনি বলেন, তোমরাই খাও। আমি বাড়িতে যাই।
জয় বাংলা মামণি এখন কেমন আছেন?
ভালো আছেন। সুস্থ হয়েছেন।
শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।
ঘরের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ধ্বনি। ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলে মনে হয়, ওরা আছে বলে শহরের বাতাসে জীবন আছে। শত্রুপক্ষের পায়ের নিচে পড়ে গিয়েও শহর মাথা তুলে রাখে ওদের জন্য। তিনি ফুটপাত ধরে হটেন। আর্মি ক্যাম্পের পাশ কাটিয়ে সাধারণ মানুষের গা-ছুঁয়ে যখন নিজের গাড়ির কাছে আসেন, দেখতে পান, সিনেমা হলের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সেপাইটির মাথার ওপর কাক উড়ছে। তিন-চারটে কাক। কা কা শব্দ তার কানে ঢুকলে তিনি মনে করেন এরাও শহরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। গোলাবারুদের বিপরীতে বেঁচে থাকার সূত্র। নির্মীয়মাণ সিনেমা হলের দালান ছাড়িয়ে আরও খানিকটুকু হাঁটতে হলো তাকে। দেখলেন, নিমগাছের ডালে সাদা ফুল। দেখলেন ফড়িং ও প্রজাপতি। একঝাক চড়ুইও আছে। ভাবলেন, বেঁচে থাকা সুন্দর। এর সঙ্গে যোগ হবে স্বাধীনতা।
বাড়ি ফিরে দেখলেন, মেরিনা ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। বেশ উত্তেজিত। বাবাকে দেখে খানিকটা দম ফেলে। ইদানীং মেয়েটি এমন আচরণ করছে। শান্ত মেজাজ হারাচ্ছে। যুদ্ধ ওকে একরোখা করেছে। অনেক কিছুই ও সহজে মেনে নিতে চায় না। তিনি বিষয়টি আঁচ করার জন্য বললেন, কী হয়েছে, মা?
আমি তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। সবই বলব। আপনি হাতমুখ ধুয়ে নিন, আব্বা। খিদে পায়নি?
হ্যাঁ, তা পেয়েছে। বেলাও তো কম হয়নি।
আম্মাও খাননি। আপনার জন্য বসে আছেন। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। খেতে খেতে কথা বলব। মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেছে। চেনা কারও আছাড় খাওয়া দেখলে খুবই খারাপ লাগে। মানতে পারি না।
শান্ত হ মা। বুঝেশুনে এগোতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপই সতর্ক পদক্ষেপ হতে হবে।
বুঝি, আব্বা। আপনি কাপড় চেঞ্জ করে আসুন। আম্মা, আসেন।
আকমল হোসেন শোবার ঘরে আসেন। আয়শাও যান। জিজ্ঞেস করেন, পরবর্তী অপারেশন কোথায় হবে? ছেলেরা কী বলল?
স্টেট ব্যাংক ভবন। ওরা একবার রেকি করে এসেছে।
রাইট সিদ্ধান্ত। কাগজে দেখলাম দুররানি আসবে। ওদের অপারেশনের সময় কখন?
সন্ধ্যা ছয়টায়। বেলা বারোটায় রেকি করবে দুলাল।
আকমল হোসেন বাথরুমে ঢোকেন। গরমে ঘেমে গেছেন। শাওয়ারের নিচে দাঁড়ালেন। যেন তাঁর প্রিয় নদী তিতাস এখন শরীরের ওপরে। মহা আনন্দে ভিজতে থাকেন। ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালোবাসতেন। ছাদে দাঁড়িয়ে ভিজতেন। নয়তো সিঁড়ির সামনের পার্কে বা দূরের মাঠে। কেউ তাকে শাসন করে ফেরাতে পারত না। আর বাড়ির কারও কাছ থেকেই বকুনি শুনতে হয়নি। কারণ, কোনো দিন জ্বর হয়নি বা ঠান্ডা লাগেনি। মা বলতেন, আমার ছেলেটার গায়ের ওপর দিয়ে বৃষ্টি গড়িয়ে যায়। কখনো ভেতরে ঢোকে না। বৃষ্টি ওর সঙ্গে খেলা করে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে শৈশবের কথা ভেবে ভীষণ আনন্দ হয় তার। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। জলকে নির্বিঘ্নে গড়াতে দেন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকেন। বেশ কিছুক্ষণ পর আয়শা দরজায় শব্দ করেন।