থাক, নিজেদের গুণ আর নিজেদের গাইতে হবে না।
ঠিক বলেছিস। এখন বিশ্ববাসী গাইবে। ওই চায়নিজরা এবং আমেরিকানরাও গাইবে। যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তাদেরকে এর মূল্য দিতেই হবে। এখন উঠছি।
আশরাফ মেরিনার দেওয়া চায়ের কাঁপে শেষ চুমুক দেয়। প্রাঙ্গণে রাখা নিজের গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার আগে আলতাফকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কেমন আছ, আলতাফ?
ভালো নেই। একদম ভালো নেই। শরীরের চেয়ে মন বেশি খারাপ।
কী হয়েছে?
গ্রামে আমার ভাইটি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। বাবাকে বলেছি ত্যাজ্যপুত্র করতে। বাবা করেছেন। শয়তানটা বলেছে, ত্যাজ্যপুত্র করলে কী হবে, আমি বাবাকে ত্যাজ্য-বাবা করলাম। আর আমার বড় ভাইকে করলাম ত্যাজ্য-ভাই। ওর মুখ দেখতে না পেলে আমার কিছু আসবে-যাবে না। ও এত বান্দর হলো কেন ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারি না।
দুঃখ পেয়ো না। নিজেদের একদল মানুষ তো এমনই করছে। দেখছ না চারদিকের অবস্থা। চেনা মানুষও খোলস বদলে ফেলে।
আলতাফ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, আমার একটাই ভয়, ডাক্তার চাচা।
আশরাফ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলে বলেন, দেশ স্বাধীন হলে ও কি বাঁচতে পারবে? মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ও মরবে। ওকে বাঁচাবে কে?
যদি কেউ এভাবে নিজের মৃত্যু চায়, তাহলে তা-ই হবে। স্বাধীনতার বিপক্ষে চিন্তা করাটাই তো সবচেয়ে বড় অপকর্ম। এই অপকর্মের জন্য কাউকে মাফ করে দেওয়ার সুযোগ নাই। কেউ মাফ করতে চাইলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। তারাও শাস্তি পাবে।
আশরাফ গাড়িতে স্টার্ট দেন। গাড়ি গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তিনি আলতাফের দিকে তাকান। আলতাফই প্রথমে মাহমুদাকে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখতে পায়। সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি। ভয়ও পায়নি। পাকিস্তানি আর্মির হাতে নির্যাতিত মাহমুদাকে বাড়িতে আনার জন্য ছুটে এসেছিল আকমল হোসেনের কাছে। তার বিপরীতে চলে গেছে তার ভাই। সে ভাইকে নিয়ে ও এখন দুশ্চিন্তায় আছে। ও ধরে নিয়েছে, দেশ স্বাধীন হবে, শুধু সময়ের ব্যাপার। আমরা সবাই আমাদের সময়কে এভাবে দেখছি। আশরাফ মতিঝিল পার হয়ে ধানমন্ডির দিকে যাবেন।
গাড়ি নিয়ে রাস্তায় ওঠেন। কোনো ওষুধের দোকানে নেমে ওষুধ কিনতে হবে। জরুরি ওষুধ সারাক্ষণ নিজের কাছে রাখতে হয়। কখন যে কোথায় দরকার। হবে, কে জানে! আশরাফের মাথায় মাহমুদার ঘটনা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
তখন আকমল হোসেন মৃদু হেসে আয়শার হাত ধরে বলেন, আজ আমার ধড়ে প্রাণ এসেছে। কয়দিন যা ভোগালে। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার জীবনে এভাবে কখনো ঘাবড়াইনি। তুমি তো দেখেছ।
ভেবেছিলে বাঁচব না?
অনেকটা সে রকমই। যমে-মানুষে টানাটানি বলে একটা কথা আছে না।
আমি মোটেই এতটা অসুস্থ হইনি। তুমি ভয় পেয়ে বেশি ভেবেছ।
তোমাকে হারানোর ভয় তো আমার আছে, আশা। আমি তোমার আগে মরতে চাই।
তোমার প্রাণটা উড়ে গিয়েছিল, এখন ফিরে এসেছে, তাতেই আমি খুশি। আজ রান্নাঘরে ঢুকব। কী খাবে, বলো?
আলতাফ বাজারে গেছে। ও কী আনে দেখি। তারপর বলব। রান্না নিয়ে আজ তোমাকে ঝামেলা পোহাতে হবে না। চলো, ড্রয়িংরুমে বসবে। তোমার উল-কাটা কই?
আমি নিচ্ছি। মেরিনা কোথায়?
ও নুসরাতের বাড়িতে গেছে। দুপুরের আগেই ফিরবে।
নুসরাতের বাড়িতে গেছে! দুপুরের আগেই ফিরবে! নুসরাতের বাড়িতে। আয়শা ভুরু কোঁচকান।
ওরা দুজনে মিলে বাংলাদেশের পতাকা বানাবে। সেসব পরিকল্পনা বোধ হয় করবে। আমাকে কিছু বলেনি। আমিও জোর দিয়ে জানতে চাইনি।
ঠিক আছে, থাক। ও এলে ওর কাছ থেকে শুনব। তুমি কি বের হবে?
হ্যাঁ, ফার্মগেটের বাড়িতে যাব। দেখা দরকার ওরা কী করছে। ওখানে ক্র্যাক প্লাটুনের ছেলেরা আসবে। দুপুরের আগেই ফিরে আসব।
ঠিক আছে, যাও।
তোমার মন খারাপ হবে না তো?
আয়শা মৃদু হেসে বলে, একটুতেই মন খারাপ করলে আমরা যুদ্ধ করব কীভাবে? তুমি ঘুরে এসো। আমি অপেক্ষা করব। একসঙ্গে ভাত খাব। অবশ্য ওখানে যদি বেশিক্ষণ থাকতে হয়, তাহলে ওদের কাছেই থাকবে। দুপুরের ভাত না হয় আমরা রাতেই খাব।
আকমল হোসেন মৃদু হেসে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর গাড়ি ছুটে যায় রাস্তায়। ভিড় আছে। গাড়ি-রিকশার ভিড়। মাঝেমধ্যে আর্মির গাড়ি দেখা যায়। আকমল হোসেন দেখলেন, রাস্তায় আর্মির মুভমেন্ট বেশি। কোথাও কিছু ঘটেছে কি? নাকি ওরা পঁচিশে মার্চের মতো কিছু একটা ঘটানোর পায়তারা করছে! ভেবেছে, শহরের গেরিলারা হয়তো কয় দিন পর শহরটা দখল করে নিতে পারে। তারপর এমন একটি রাস্তায় গাড়ি চালাতে তিনি ভীত হন না। বরং স্বস্তিই পান। ওদেরকে সন্ত্রস্ত-আতঙ্কিত দেখলে নিজের ওপর আস্থা বাড়ে। বোঝেন, যে শক্তি জাহির করার জন্য ছেলেরা রাস্তায় নেমেছে, সেখানে তারা সফল। আর এই সাফল্যে আকমল হোসেন নিরাপদে ফার্মগেটের বাড়িতে ঢুকে যান। গাড়ি রেখে আসেন বেশ খানিকটা দূরে। কাছাকাছি গাড়ি নিয়ে যেতে নিরাপদ বোধ করেন না। বাড়ির দুর্গচরিত্র জানাজানি হয়ে গেলে বিপদের আশঙ্কা আছে। এমনিতেই এই বাড়ি থেকে অস্ত্রশস্ত্র নেওয়ার জন্য ছেলেদের প্রায়শই আসতে হয়। গাড়ি দূরে রেখে ফুটপাত ধরে হেঁটে এদিকওদিক তাকিয়ে আড়ালে ঢুকে পড়েন। তারপর গেরিলাদের হাইড।
ড্রাইভিং সিটে বসে থাকে আলতাফ।
গাছপালায় ঘেরা ছায়াচ্ছন্ন বাড়িটি ভীষণ মন টানে। এখানে এলেই তার গাছের নিচে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ইট-কাঠের বাড়িতে এমন স্নিগ্ধতা বুঝি আর হয় না। আজও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস টানলেন। ছোট ছোট বুনো ঝোপে পা রাখলেন। পা দিয়ে ফুটে থাকা লজ্জাবতী ফুল বুজিয়ে দিলেন। পেছন থেকে স্বপন হাততালি দিয়ে দৌড়ে আসে।