খেতে খেতে কায়েস উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে, আমাদের জন্য এতকিছু রান্না করেছেন, খালাম্মা?
আয়শা খাতুন মৃদু হেসে বলেন, তোদের মন ভরলে আমি খুশি।
আকমল হোসেন এক গ্রাস ভাত মুখে পুরে বলেন, যুদ্ধের সময় সব খাবারই সমানভাবে খেতে হয়।
মিজারুল দ্রুতকণ্ঠে বলে, আমরা সেভাবেই খাই, খালুজান। মেলাঘরের ক্যাম্পে বুটের ডাল আর রুটি খেতে আমাদের একটুও খারাপ লাগে না। বাড়িতে এলে মায়েদের ভালোবাসার রান্না আমাদের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। তবে না পেলে ক্ষতি নাই।
আকমল হোসেন শান্ত কণ্ঠে বলেন, বুঝেছি, তোমরা রিয়াল ফাইটার। তোমাদের মেলাঘরের খবর কী? শুনতে পাচ্ছি, শহরের শত শত ছেলে গিয়ে ওখানে জড়ো হয়েছে।
একদম ঠিক, খালুজান। আমাদের মতো ছেলেরা যুদ্ধ করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। ঢাকা থেকে ত্রিপুরা বর্ডার কাছে। তাই পার হওয়া সহজ। ওখানে আছেন দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ। তিনি রেগুলার আর্মির পাশাপাশি গেরিলাবাহিনী গড়ে তুলে যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন।
সে আমি বুঝতে পেরেছি। নিশ্চয়ই তিনি একটি সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করেছেন।
হ্যাঁ, করেছেন। আমাদের ট্রেনিং দেওয়ার পরে ঠিক হয়েছে এই স্কোয়াডের ১৬ জনের একটি দলকে ঢাকায় পাঠানো হবে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা এসেছি। আমাদের প্রত্যেককে চারটি করে গ্রেনেড আর ২০ পাউন্ড বিস্ফোরক দেওয়া হয়েছে।
আরও লাগবে। অস্ত্র, গোলাবারুদ—
সব পাব, খালুজান। আস্তে আস্তে আসবে।
তোমাদের এখনকার কাজ শহরটাকে চাঙা করে তোলা। রেগুলার আর্মির পাশাপাশি গেরিলাবাহিনী। সঙ্গে সাধারণ মানুষ। গেরিলারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে ছায়ার মতো মিশে থাকবে।
ঠিক বলেছেন, খালুজান।
গেরিলাদের কণ্ঠে উৎসাহের ধ্বনি।
মেলাঘরে আমাদের প্রশিক্ষণ দেন ক্যাপ্টেন হায়দার। ক্যাম্প ভিজিটে এসে তিনি তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে আমাদের চাঙা করে তুলেছিলেন। বলেছিলেন, কোনো স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না। চায় রক্তস্নাত শহীদ।
আয়শা খাতুন খানিকটা অস্বস্তির কণ্ঠে বলেন, এসব কথা থাক, বাবারা। তোমরা ভাত খাও।
আমরা পেট পুরে খাব, খালাম্মা। আপনি একটুও ভাববেন না। আপনারা আছেন বলেই তো আমরা যুদ্ধের মায়ায় নিজেদের ভরাতে পারি।
আমরা ঢাকা শহরে আতঙ্ক তৈরি করব। আমরা হলাম ক্র্যাক প্লাটুন।
আকমল হোসেন শব্দ করে হাসেন। হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিয়ে এক চুমুক পানি খেয়ে বলেন, আমি তো জানি তোমাদের কাজ হবে পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। ওদের বুঝিয়ে দেওয়া যে ওরা যা করছে, সেটা সহজে মেনে নেবে না বাঙালিরা।
ঠিক, খালুজান। ওদের আমরা ব্যতিব্যস্ত করে রাখব। একদিকে গ্রেনেড ফাটা সামলাতে সামলাতে ওরা দেখবে ওদের পেছনে আরেকটি ফেটেছে। ওটা সামলে ওঠার আগেই আরেকটি ফাটবে। আমাদের কমান্ডার খালেদ মোশাররফ এমনই বলেন।
তিনি আরও বলেন, বিদেশি সাংবাদিক এবং ডোনারদের বোঝাতে হবে যে পাকিস্তান সরকার যে শান্ত পরিস্থিতির কথা প্রচার করছে, পূর্ব পাকিস্তানে সেই পরিস্থিতি নেই। বীর বাঙালি পাকিস্তানি বাহিনীর নাকের ডগায় গেরিলা অপারেশন চালাচ্ছে।
বুঝেছি, তোমরা কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়েছ। আমার বুকের ছাতি দশ হাত বেড়ে গেল, বাবারা।
এটুকু বলে আকমল হোসেন আবার পানি খান। বলেন, আমার বাড়িতে একটা দুর্গ গড়ে তোলা আজকে সার্থক মনে হচ্ছে। আমার ছেলে যেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, সেদিন আমাকে আর ওর মাকে কিছু বলে যায়নি। শুধু মেরিনা জানত। দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই ও বেরিয়ে যায়। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে এক টুকরো পাউরুটি আর সেদ্ধ ডিম খেয়েছে। মেরিনা চা দিলে বলেছিল, খাব না। যেতে হবে। অন্যরা আমার জন্য অপেক্ষা করবে। তুই বাবা-মাকে দেখে রাখিস। মেরিনার কাছ থেকে এটুকু শুনে আমি ভেবেছিলাম, মেয়েটি আমাকে রূপকথার গল্প বলছে। সেদিন ওর মা খুব কেঁদেছিল। আমি বেকুব বনেছিলাম। কাঁদতে পারিনি। শুধু নিজেকে বুঝিয়েছি যে এটাই বাস্তব। এমনই তো হওয়া উচিত। আজ তোমাদের পেয়ে আমার মনে হচ্ছে, তোমরা সোনার কাঠি, রুপার কাঠি এনেছ। আর ঘুমানোর সময় নেই। আকমল হোসেন থামলে যোদ্ধারা তার মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে। আয়শা খাতুন আবার বলেন, তোমরা খাও, বাবারা।
কিন্তু কেউই চোখ নামাতে পারে না। ভাতের গ্রাসও মুখে তোলে না। ওদের মনে হয়, আকমল হোসেন আরও কিছু বলবেন। তখন তিনি বলেন, যেদিন ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করল, সেদিন থেকেই আমরা যুদ্ধে ঢুকে পড়ি। এ নিয়ে আমার কোনো দ্বিধা ছিল না। আমি ধরে নিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধু আমাদের এ পথেই পরিচালনা করবেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পর আমরা যুদ্ধক্ষেত্র তৈরিতে যুক্ত হই। এখন আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। সীমান্তে হবে সরাসরি যুদ্ধ। আর গেরিলা অপারেশন হবে সরাসরি যুদ্ধের নেপথ্য ক্ষেত্র। শহীদ এবং স্বাধীনতা শব্দ দুটোকে আমরা এক সুতায় গেঁথে গলায় পরেছি।
তিনি থামলে ছেলেরা একসঙ্গে বলে, ঠিক। ঠিক, খালুজান। আপনি আমাদের দোয়া করবেন।
ওরা ভাতের থালার ওপর ঝুঁকে পড়ে। খেতে শুরু করে। অন্যদিকে তাকায় না। আয়শা খাতুন ওদের প্লেটে এটা-ওটা তুলে দেন। ওরা আপত্তি করে না। খাওয়া শেষে মেরিনা যখন কাউন চালের পায়েস নিয়ে আসে, তখন মিজারুল মৃদুস্বরে বলে, আমরা কি পারব?