আকমল হোসেন হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখেন। আয়শা খাতুন তখন রান্নাঘরে বসে প্রতি ঘরের জন্য একটি করে মোমবাতি জ্বালান। মোমবাতির মৃদু আলো দেবদূতের উড়ে আসার কথা মনে করিয়ে দেয়। আয়শা খাতুন প্রতিটি মোমের শিখার দিকে তাকিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করার মতো করে বলেন, আজ বোধ হয় আমার জন্মদিন। কোন তারিখে আমার জন্ম হয়েছিল, আমার মা তা আমাকে বলতে পারেননি। আমি তো নিজে নিজে একটা দিন ভাবতেই পারি।
আকমল হোসেন দরজায় দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে ডাকেন, আয়শা।
বলল, শুনছি। কয়জন চিৎকার করেছে বলে তোমার মনে হয়?
তিন থেকে পাঁচজন।
আমার মনে হয় ওরা তিনজনই ছিল।
কাল সকালে হয়তো আমরা লাশগুলো পাব।
হাসপাতালে নিয়ে যাবে, নাকি কবরস্থানে?
সরাসরি কবরস্থানে যাওয়া তো উচিত। গাড়ি চলাচলের জন্য ওরা রাস্তা পরিষ্কারও করতে পারে।
হ্যাঁ, সে জন্য ওরা হয়তো লাশগুলো নিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে মাটিচাপা দিতে পারে। দাফন করবে না।
ওরা কারা হতে পারে? সাধারণ মানুষ, নাকি গেরিলা।
আকমল হোসেন দুপা পিছিয়ে গিয়ে বলেন, আমি জানি না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলেন, এই শহরে যারা শত্রুপক্ষের সঙ্গে মিশে যায়নি, তাদের সবাই গেরিলা—যোদ্ধা কিংবা সহযোগী। শহরের সব মানুষের চরিত্র এখন এমন।
আয়শা খাতুন তীব্র দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকান। আকমল হোসেন থমকে গিয়ে ভাবেন, আয়শা খাতুন এই মুহূর্তে এমন অচেনা কেন?
মেরিনা পাশে এসে দাঁড়ায়।
আপনাদের কী হয়েছে?
ওদের পানি দিয়েছিস?
দিয়েছি। ওরা এক জগ পানি শেষ করে আরেক জগ পানি চেয়েছে। আমি দেখেছি পাঁচজনই দুই গ্লাসের বেশি পানি খেয়েছে।
খেতেই পারে। তাই বলে ওরা ক্লান্ত নয়।
আমি ওদের ক্লান্ত বলিনি, মা।
তৃষ্ণার্ত বলতে চেয়েছ?
আমি জানি না, আমি কী বোঝাতে চেয়েছিলাম। আমি শুধু আমার দেখার কথা বলেছিলাম। ঠিক আছে, আমি আমার ঘরে যাচ্ছি।
মায়ের কাছ থেকে একটি মোমবাতি উঠিয়ে নিয়ে মেরিনা নিজের ঘরে যায়। বাবা-মা দুজনের কেউই আর কথা বলেন না। শুধু মারুফের ঘর থেকে পাঁচজন যোদ্ধার নানা কথা ভেসে আসছে। তার অনেক কিছুই বোঝা যায় না। মেরিনা নিঃশব্দে নিজের ঘরের দরজা ভেজিয়ে দেয়। এই একলা ঘরে বাইরের পৃথিবী ওর কাছে নিবিড় হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্রী ও। অনার্স শেষ করেছে। মাস্টার্স পরীক্ষা হয়নি। এখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। গেরিলাবাহিনীর যুদ্ধ। পড়ার টেবিলের ওপর মোমবাতি রেখে চেয়ার টেনে বসে। খাতা-বই উল্টায়। এলোমেলো করে রেখে দেয়। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের একটি বাক্য সাদা কাগজে লিখতে থাকে—দ্য সান ইজ নিউ এভরি ডে। বাক্যটি বারবার লিখে, কাটে। ওই বাক্যের ওপর ফুলপাখি আঁকে। পতাকা আঁকে। বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকে। ছবি আঁকার সহজাত ব্যাপার আছে ওর ভেতর। পড়তে চেয়েছিল আর্ট কলেজে। পরে সিদ্ধান্ত বদলায়। ভাবে, এই বাক্যটিতে সুর দিলে গান হবে—সান ইজ নিউ এভরি ডে-ও গুনগুন করার চেষ্টা করে। ভালো লাগে না। খাতা বন্ধ করে চেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে রাখে। ভাবে, সূর্য তো প্রতিদিন নতুন করে ওঠে। এই আমিও নতুন সূর্য দেখি। কারণ, আমি কখনো এক রকমভাবে সূর্য দেখি না। সূর্য ওঠার বৈচিত্র্য আছে। প্রতিদিন সূর্য ওঠে, আমরা সবাই এমন কথা বলেই থাকি, ভাবি না যে এই ওঠা দেখার মধ্যে মানুষের ভাবনার সূত্র থাকে। এই ভাবনার মধ্য দিয়েই মানুষ নিজের দিন গোনে। এখন এই শহরের মানুষ দিন গুনছে। প্রতিদিন নতুন সূর্য দেখছে। একদিন এই দেশের মানুষের কাছে সূর্যটা আকাশ ভরে উঠবে। পূর্ব-পশ্চিমউত্তর-দক্ষিণ—আকাশের সবটুকু জুড়ে উঠবে। সে জন্যই তো এই বাড়িটা এখন একটা দুর্গ। এখান থেকে নতুন সূর্য দেখার যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। শহরের অনেক বাড়ি এমন দুর্গ হয়েছে।
মেরিনা দুহাতে মুখ ঢাকে।
দরজা ফাঁক করে ঢোকে মন্টুর মা।
আপা।
মেরিনা মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।
কী বলবেন? মা ডাকছে।
হ্যাঁ। আসেন। তারপর দুপা বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে বলে, ভাইজানরা কোথায় যুদ্ধ করবে?
ঢাকায়। এই শহরের একটি এলাকায় ওরা অপারেশন চালাবে।
এত ছোট জায়গায় যুদ্ধ হয়?
হয় খালা, হয়। আবার দেশের সীমান্তে বড় আকারের যুদ্ধ হয়।
কী যে দিন শুরু হলো। আমার এখন গেরামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য মন পোড়ে। আমি বেশি দিন থাকব না। অল্প কয়েক দিন থেকেই চলে আসব।
বাড়িতে তো আপনার কেউ নাই। যেতে হবে কেন?
আমি চাই, আমার মরণ দেশের বাড়িতে হোক। গ্রামের মাটি আমার আসল জায়গা। ওই মাটির নিচে শুয়ে থাকতে চাই। ঢাকা শহরে আমি কবর চাই না।
পাগল, এখনই এসব কথা ভাবতে হবে না। স্বাধীনতা দেখার আগে মরার কথা ভাববেন না। আপনি না বলেন, হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে।
বলি তো। ছোটবেলা থেকে তো এমনই শিখেছি।
তাহলে ভাবাভাবির কিছু নেই। মৃত্যু যখন হওয়ার হবে। চলেন, ভাত খেতে যাই।
মন্টুর মা অকারণে হাসে। কাপড় টেনে মাথা ঢাকে। দুহাত গালে ঘষতে ঘষতে বলে, এশার নামাজ পড়ার সময় আল্লাহরে বলি, আল্লাহ মাবুদ, আজ রাত পোহালে এক দিনের আয়ু পাব। না পোহালে। কথা শেষ করে না মন্টুর মা। দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।
ডাইনিং টেবিল সরগরম হয়ে উঠেছে। নিচুস্বরে কথা হলেও গমগম করে ঘর। তিনটে অতিরিক্ত চেয়ার দিয়ে সবার বসার জায়গা করা হয়েছে। মারুফ আর মেরিনা নিজেদের প্লেট হাতে তুলে নিয়েছে। ঘরে আলো জ্বালানো হয়েছে। আলো জ্বলছে শুধু রান্নাঘর আর ডাইনিংরুমে।