মারুফ জানে, এটি মায়ের প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত।
মেরিনার মনে হয়, বৈশাখ মাসে মা শ্রাবণের গান গাইছেন। বেশ লাগছে শুনতে।
আকমল হোসেন ভাবেন আয়শা একটি দারুণ গান গাইছে। এই গানটি এই সময়ে এই বাড়িতে খুব দরকার ছিল।
আয়শা খাতুনের গুনগুন ধ্বনি ঘরে আর আবদ্ধ থাকে না। জানালার দুই পাল্লার ফাঁক দিয়ে বাইরে ছড়াতে থাকে। এই সময় গেরিলাযযাদ্ধারা এই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালে বুঝতে পারবে গানের সুর ওদের জন্য আবাহন সংগীত। এখনই সময় একটি গেরিলা অপারেশনের প্রস্তুতি নেওয়ার।
০২. তখন দরজায় টুকটুক শব্দ হয়
তখন দরজায় টুকটুক শব্দ হয়।
সামনের দরজা দিয়ে ঢেকে দুজন। ওমর আর কায়েস।
এসো, বাবারা।
আয়শা খাতুন দুহাত বাড়ালে ওরা পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। আকমল হোসেন ওদের বুকে জড়িয়ে ধরেন। একটু পরে গ্যারেজের পাশের দরজায় শব্দ হয়। ছুটে যায় মারুফ। দরজা খুললে ঢোকে তিনজন। মিজারুল, স্বপন আর ফয়েজ।
এসো, বাবারা।
ওরা আয়শা খাতুনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
ভালো আছেন, খালাম্মা?
তোমাদের দেখলে ভালো থাকার সাধ বেড়ে যায়। বসো।
মেরিনা ততক্ষণে জগভর্তি পানি আর গ্লাস নিয়ে আসে। ওদের পানি খাওয়া শেষ হলে আকমল হোসেন জিজ্ঞেস করেন, রাস্তা কেমন দেখলে?
এতক্ষণে রাস্তা নীরব হয়ে গেছে।
মানুষজন গেরিলাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
ওমর দুহাত তুলে বলে, আজ একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে।
প্রশ্ন না করে সবাই ওর দিকে তাকায়।
আমি আর কায়েস এক রিকশায় এসেছি। রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করেছে, আপনারা কোথায় যাবেন, ভাইজান? আমি বললাম, হাটখোলায়। ও সঙ্গে সঙ্গে বলল, সে তো আমি জানি। রিকশায় ওঠার সময় বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আপনারা আরও কোথাও যাবেন। জিজ্ঞেস করলাম, এ কথা কেন মনে হলো তোমার? বলল, এমনি মনে হলো। আপনাদের দেখে মনে হলো, আমিও আপনাদের সঙ্গে যাই। নেবেন আমাকে? বলেছি, আর একদিন। আজকে আমরা মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাব। আমাদের তাড়া আছে। ও মৃদু হেসে বলল, আমি জানি, আপনাদের তাড়া আছে। আমরা তো এ বাড়ি থেকে বেশ অনেকখানি দূরে নেমেছি। ওকে ভাড়া দিতে গেলে বলল, যেদিন আবার দেখা হবে সেদিন ভাড়া নেব। আজ থাক। এই বলে ও রিকশা নিয়ে চলে যায়। আমাদের দিকে পেছন ফিরে তাকায় না। ও চোখের আড়ালে চলে গেলে আমরা অন্য গলিতে ঢুকে আবার অন্যদিকে বের হয়ে এই বাড়িতে আসি।
আকমল হোসেন ঠান্ডা মাথায় শান্তস্বরে বলেন, মে গড় ব্লেস ইউ, মাই বয়েজ।
ওদের নিয়ে আমার ঘরে যাই, আব্বা?
হ্যাঁ, যাও। অপারেশন-পরিকল্পনার কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে আমাকে ডেকো।
আপনি তো কালকে আমাদের নিয়ে গাড়ি চালাবেন?
হ্যাঁ, কাল আমিই তোমাদের চালক। এখন তোমরা কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। খাবার টেবিলে বসে তোমাদের অন্য কথা শুনব।
যোদ্ধারা মারুফের পিছু পিছু ওর ঘরে যায়। ওরা সে ঘরে দাঁড়িয়ে শুনতে পায় আয়শা খাতুনের কণ্ঠে গুনগুন গান। তিনি কাজ করতে করতে গাইছেন, ওই শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে–
ছেলেরা বিছানায়-মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে। কেউ হাঁটু মুড়িয়ে, কেউ কাত হয়ে। কেউ দেয়ালে ঠেস দিয়ে। তখন প্রশ্নটি ওমরকে করে মারুফ। প্রশ্নটি এতক্ষণ ওর বুকের ভেতর খচখচ করছিল। বলে, রিকশাওয়ালার কথায় তোর কী মনে হয়েছে, মারুফ?
ওমর নির্বিকার কণ্ঠে বলে, আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। এত সহজে সাধারণ মানুষের কাছে ধরা পড়া উচিত নয়। আমরা সাধারণ মানুষের ছায়ায় মিশে থাকব, কিন্তু কেউ আমাদের চিনতে পারবে না।
স্বপন সোজা হয়ে বসে বলে, হ্যাঁ, আমারও তা-ই মনে হয়েছে। ওরা এত তাড়াতাড়ি আমাদের চিনবে কেন? কোনো-না-কোনোভাবে আমাদের বড় ধরনের বোকামি হয়েছে।
মিজারুলও তা-ই বলে, আমিও তা-ই ভেবেছি। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে খালেদ মোশাররফ বলেন, গেরিলাযুদ্ধ কাউবয় অ্যাডভেঞ্চার নয়।
সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়ে।
ঠিক।
আমাদের উত্তেজনা কমাতে হবে। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে।
বাইরে থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসে। সঙ্গে প্রবল আর্তচিৎকার। ওরা পরস্পরের হাত চেপে ধরে। মেরিনা হাতে ট্রে-ভর্তি চায়ের কাপ আর স্যান্ডউইচ নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র। পেছন থেকে আকমল হোসেন হাত বাড়িয়ে বাতির সুইচ অফ করে দেন। অন্য ঘরের বাতিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ড়ুবে যায়। সবাই স্তব্ধ হয়ে কান পেতে আর্তচিৎকার শোনে। কিছুক্ষণের মধ্যে চিকার থেমে যায়। রাস্তায় আর্মির গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ হয়। চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে থাকে। শুধু আকমল হোসেন ঘড়ঘড়ে গলায় বলেন, আল্লাহ মালুম, কয়জন গেল!
মেরিনা পাশে দাঁড়িয়ে বলে, একজনের বেশি, আব্বা। চিক্কার একজনের ছিল না।
আমারও তা-ই মনে হয়েছে, মা। চিৎকার কয়েকজনের ছিল।
গেরিলাদের কেউ একজন বলে, প্রতিশোধ।
ওরা একসঙ্গে বলে, মৃত্যুর বদলে মৃত্যু চাই।
মেরিনা ঘরের মধ্যে এক পা বাড়িয়ে বলে, ভাইয়া, তোমাদের চা।
দে। মারুফ উঠে ট্রেটা নেয়। তোমরা স্যান্ডউইচ খাও। আমি পানি আনছি।
মেরিনা বাবার হাত ধরে।
আব্বা, আপনাকে চা দেব?
হ্যাঁ, দে মা। আমি ডাইনিং টেবিলে আসছি। তোর মা কই? সাড়া পাচ্ছি না যে?
বুঝতে পারছি, গুলির শব্দ শুনে মা গান থামিয়েছেন।
তোর মাকে গুনগুন করতে বল। গুলির বিপরীতে গান তো গাইতে হবে। গুলি মৃত্যু হলে গান জীবন।
আপনার কথা খুব কঠিন, আব্বা। আপনি নিজে মাকে গুনগুন করতে বলেন।