দেশের এবং স্বাধীনতার। আকমল হোসেনের কণ্ঠস্বর ভাবলেশহীন। চেহারায় ভাবান্তর নেই।
আয়শা খাতুন দুহাতে চোখের পানি মুছে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলেন, তুমি এভাবে বললে?
হ্যাঁ, বললাম। তারপর মেয়ের দিকে ঘুরে বলেন, মা মেরিনা, তোমার শরীরও তোমার না।
আয়শা খাতুন গলা উঁচিয়ে বলেন, এসব কী বলছ তুমি।
যা বলছি, ঠিকই বলছি। মেরিনার শরীরও দেশের এবং স্বাধীনতার। যুদ্ধের সময় কারও শরীরের দাবি তার নিজের থাকে না।
মেরিনা দুহাতে মুখ ঢাকে। এক নিষ্ঠুর অনুভব তার ভেতরটা ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে ঘর। কারও মুখে কথা নেই। একটু পর মারুফ নিজের মতো করে বলতে থাকে, এই বাড়ি আমাদের দুর্গ। এখানে অস্ত্র আছে, খাদ্য আছে। গেরিলা অপারেশন পরিকল্পনা করার সুযোগ আছে। বয়সীদের সহযোগিতা আছে। প্রস্তুতির জন্য সাহস সঞ্চয়ের নেপথ্য শক্তি আছে। দুর্গের সবাই যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাকে। তাহলে দুর্গে আর কী থাকে? মারুফ বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, আব্বা, একটি দুর্গে কী কী থাকে?
ঘরের তিনজন মানুষই একযোগে মারুফের দিকে তাকায়।
আব্বা, আপনি কি কোনো দুর্গ দেখেছেন?
ঢাকা শহরে লালবাগ দুর্গ আছে। তোমাদের তিন-চারবার নিয়ে গিয়েছি সেখানে।
এই দুর্গের কথা বলছি না।
আমি ধরে নিয়েছি তুমি ইতিহাসের দুর্গের কথা বলছ। বই পড়ে তেমন দুর্গের ধারণা আমি করি।
আপনার কি মনে হয় আমাদের বাড়িটি একটি দুর্গ?
আসল দুর্গ নয়, তবে দুর্গের ক্যারেক্টার তৈরি হয়েছে এ বাড়ির।
গেরিলারা এলে এ বাড়ির মাটি খুঁড়ে আমরা অস্ত্র বের করব। আপনি তার তত্ত্বাবধান করবেন। তারপর প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র তুলে দেবেন।
এই বাড়িটা জনযুদ্ধের দুর্গ। এসো, আমরা এখন ম্যাপ দেখি।
আকমল হোসেন সোফায় বসে থাকেন। মাঝের টেবিলটা টেনে তার সামনে রাখা হয়েছে। তিনজনে টেবিলের চারপাশে জড়ো হয়। আয়শা খাতুনকে একটি মোড়া দেয় মেরিনা। মারুফ আর ও মাটিতে বসে।
এই দেখ, এখান দিয়ে আসবে ওরা। ওরা নদীপথে আসবে। চালের বস্তাভর্তি নৌকায় আসবে। ওদের অস্ত্রগুলো ওসব বস্তার আড়ালে লুকানো থাকবে। নদীর ওপার থেকে অস্ত্র এনে রায়েরবাজারের এই বাড়িতে ওঠানো হবে। একতলা টিনের বাড়ি। সামনে উঠোন আছে। উঠোনে আম-কাঁঠাললেবু-আতাগাছের আড়াল আছে। এই পথে আসার জন্য এই জায়গাটি গেরিলাদের এন্ট্রি পয়েন্ট। আমার মনে হচ্ছে, ওরা এতক্ষণে শহরে ঢুকে গেছে। আজ সকালেই আমি ওই বাড়ির সবকিছু দেখেশুনে এসেছি। মোয়াজ্জেমকে বলে এসেছি কী করতে হবে না-হবে। আশা করি, সবকিছু ঠিকঠাকমতো চললে ওরা অল্পক্ষণে পৌঁছে যাবে।
মারুফ আয়শা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বলে, সেটাই হবে আমার মায়ের জন্য সবচেয়ে আনন্দের সময়। অপেক্ষার সময় মাকে অস্থির করে রেখেছে।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস তুই। তা ছাড়া এই বাড়িটাকে যদি আমরা দুর্গ বলি, তবে তোর মা এই দুর্গের রক্ষক।
আয়শা খাতুন বিচলিত না হয়ে বলেন, বাড়িতে অস্ত্র রাখার ব্যবস্থা তুমি নিজে করো। রক্ষক আমি একা নই। ছেলেদের হাতে অস্ত্র তুমিই তুলে দাও।
একদিন আমি না থাকলে ওই কাজটিও তোমাকে করতে হবে।
মারুফ দ্রুতকণ্ঠে বলে, একদিন আমরা কেউই না থাকতে পারি, আব্বা। এই আমি কাল যে অপারেশনে যাব, সেখান থেকে জীবিত না-ও ফিরতে পারি। কিংবা আর্মি যদি এই বাড়িতে আসে এবং তোমার লুকানো জায়গা থেকে অস্ত্র খুঁজে বের করতে পারে, তাহলে তো আমাদের কারও রক্ষা থাকবে না।
মারুফের কথা শেষ হলে অকস্মাৎ ঘর নীরব হয়ে যায়। একটুক্ষণের নীরবতা মাত্র। পরক্ষণে চেঁচিয়ে ওঠে মেরিনা, আমাদের এভাবে ভাবা উচিত না, একদম না। আমাদের শুধু মনে রাখতে হবে যে আমরা যুদ্ধ করছি। আমরা স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতার জন্য যত দিন প্রয়োজন তত দিন যুদ্ধ করব। দেশটা ধ্বংসস্তৃপ হয়ে গেলে, পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও আমরা সেই ছাইয়ের ওপর ফিনিক্স পাখি হয়ে জেগে উঠব। আমাদের কোনো ভয় নেই, আব্বা।
তোদের সাহস আছে বলে আমাদেরও কোনো ভয় নাই রে, ছেলেমেয়েরা–
আমারও কোনো ভয় নাই। ওদের জন্য আমার বাড়িতে গরম ভাত থাকবেই, যেন ওরা বলতে না পারে যে ক্ষুধার জ্বালায় আমরা অস্ত্র হাতে নিতে পারিনি।
আবার ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আকমল হোসেন নিজের হাতে আঁকা ম্যাপটি দেখেন। আয়শা খাতুন মেয়ের ডান হাত টেনে নিজের কোলের ওপর রাখেন। বাম হাত বাড়িয়ে মারুফের হাত ধরেন। মৃদুস্বরে বলেন, বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করতে বলেছেন। আমরা তৈরি করতে পেরেছি। প্রয়োজনে। রক্তও দেব।
স্ত্রীর কথার সূত্র ধরে আকমল হোসেন মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেই বলেন, তাঁর ডাকে দেশের মানুষ জেগেছে। একজন নেতা একলা থাকতে পারেন না। মানুষকে জাগানোই নেতার কাজ। দেখা যাক, কী হয়।
কী হয় বলবেন না, আব্বা। হবেই। স্বাধীনতা শব্দটিকে আমাদের বুকের ভেতর নিতে হবে। তারপর যাবে মাথার ওপরে। তারপর উড়বে আকাশে। পিছু হটার রাস্তা আমরা নিজের হাতে বন্ধ করে দিয়েছি।
ঠিক। আকমল হোসেন চোখ বড় করে সবার দিকে তাকালেন। তার উচ্চারিত ঠিক শব্দ বদ্ধ ঘরের ভেতরে ধ্বনিত হয়। সে শব্দ নিজের ভেতরে নিয়ে আয়শা খাতুন গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করেন। বাড়ির সবাই জানে, গুনগুন করে গান গাওয়া আয়শা খাতুনের প্রিয় অভ্যাস। রান্নাঘরে কাজের সময় তিনি গান করেন। অবসরে তো করেনই। রাতে খাওয়ার পর ডাইনিং টেবিলে বসেই সবার অনুরোধে তাকে গাইতে হয়। মেজাজ ভালো থাকলে তিনি গান গাইতে না করেন না। রবীন্দ্র-নজরুলসংগীত গেয়ে থাকেন। কিংবা হামদ-নাত বা কীর্তন। নিজে নিজে শেখা এসব গানের সুর নিয়ে তিনি ভাবেন না। শুনে শুনে শেখা হলেও সাধ্যমতো শুদ্ধ সুরে গাইতে চেষ্টা করেন। আকমল হোসেন বিবাহবার্ষিকীতে তাঁকে গানের বই উপহার দেন। তাঁর ভান্ডারে অনেকগুলো গানের বই আছে। আজও তার গুনগুন ধ্বনিতে গানের বাণী উচ্চারিত হয়—ওই শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে