মেরিনা যোদ্ধাদের সঙ্গে যায়। আয়শা খাতুন বারান্দায় বসে গাড়ি বেরিয়ে যেতে দেখেন। মেরিনা বারান্দায় উঠে এলে দুজনে একসঙ্গে পেছনের বারান্দায় আসে।
সবকিছুই ঠিকঠাকমতো হয়। আকমল হোসেন নিজে তদারক করেন। বারান্দা পরিষ্কার করে পরিকল্পনামতো ভাঙা টেবিল-চেয়ার ইত্যাদি রাখা হয়। আলতাফ গ্যারেজের কাছে জড়ো করে রাখা শুকনো খড়ি চেয়ার-টেবিলের পাশে জড়ো করে রাখে। আয়শা খাতুন বারান্দার দরজায় তালা লাগিয়ে দেন। আলতাফ নিজের ঘরে চলে যায়।
অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন আকমল হোসেন, আয়শা খাতুন, মেরিনা। দুই বস্তা অস্ত্র লুকিয়ে রাখার পর পরিস্থিতি তাদের পক্ষে আছে, এটা কেউ ভাবতে পারছেন না। আশঙ্কার প্রহর গুনছে। একবার মনে হয়, আশঙ্কার সময় কেটে গেছে। অনেক সময় পার হয়ে গেছে। যদি কেউ খবর পেয়ে থাকত, তাহলে এই সময়ের মধ্যেই বাড়িতে হানা দিত। তার পরও চুপচাপ বসে থাকেন তিনজন। টিভি ছেড়ে রাখেন। দেখার মতো প্রোগ্রাম নয়। তার পরও সময় কাটাতে হয় তাদের। কোথাও থেকে কোনো ফোন আসে না। যারা অস্ত্র রেখে গেছে, তাদেরও ফোন আসে না। তারা নিরাপদ শেল্টারে যেতে পেরেছে কি না, সে খবরও পাওয়া হয়নি। নিজেরাও কোনো দুর্গবাড়িতে ফোন করেন না। শুধু অপেক্ষা—যেন কোনো দুর্যোগের ঘনঘটা নেমে না আসে। যেন কেউ অস্ত্র রাখতে দেখেনি এটুকু জেনে স্বস্তিতে থাকা। যেন অস্ত্রগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগে। যেন যোদ্ধাদের হাতে অস্ত্রের ঝনঝনানি সরগরম করে দেয় শহরের রাস্তা।
মধ্যরাত গড়িয়ে যায়।
মেরিনা বলে, আব্বা, আমরা কি ধরে নিতে পারি যে আমাদের বিপদের সময় কেটে গেছে? ভয়ের আর কিছু নেই? গেরিলারা নিরাপদে আছে।
না, মা। এত সহজ করে কোনো কিছু ভেবো না। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে আমরা ঝুঁকিতে আছি। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ভুল যেন আমাদের বিপদে না ফেলে।
মেরিনা মাথা নাড়ে। বলে, বুঝেছি। খবর পাওয়ার অপেক্ষা আমাদের মাথা থেকে কখনো সরবে না। সব সময় নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আলতাফ মুখ বাড়ায়।
স্যার, আমি ঘুমোতে যাই?
যাও। শুয়ে পড়ে গে। আজ তুমি একটা বড় কাজ করেছ। অবশ্য প্রায়ই তোমাকে করতে হয়।
আমিও যাই, আব্বা?
যাও, মা।
মেরিনা নিজের ঘরে যায়। বিছানায় শুয়ে পড়ার পরও ঘুম আসে না। সতর্ক থাকার একধরনের আতঙ্ক আছে। সেই আতঙ্ক নিয়েও টেবিলে এসে বসে। বাবা-মায়ের সঙ্গে যখন ড্রয়িংরুমে ছিল, তখন ওর ভীষণ ঘুম পেয়েছিল। দুচোখ জড়িয়ে যাচ্ছিল। হাই উঠছিল। এখন মনে হচ্ছে, দুচোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। মাত্র কতটুকু সময় এক ঘর থেকে অন্য ঘরে আসা, বাথরুমে যাওয়া, পানি খাওয়া—মাত্র এতটুকু। কিন্তু মনে হচ্ছে, মাঝখানে যোজন যোজন ব্যবধান। ও ঘরের বাতি বন্ধ করতে করতে ভাবে—না, এত রাতে টেবিলে নয়। এখন ঘুমোতেই হবে। খুব অল্প সময়ে বাড়িতে একটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে। এই একটি ঘটনার ফলাফল বিপুল বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। ও উঠে বারান্দায় আসে। দেখতে পায়, আকমল হোসেন আর আয়শা খাতুন বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে বসে আছেন।
আমিও বসব, আম্মা?
ঘুম আসছে না বুঝি?
না। মৃদু হেসে আরও বলে, অস্ত্র রাখার বিষয়টি এত এক্সসাইটেড ছিল যে স্নায়ু এখনো টানটান হয়ে আছে। ঝিমিয়ে যাচ্ছে না।
তাহলে আয়। রাতের অন্ধকারে আয়শার কণ্ঠস্বর পৌঁছাতে সময় লাগে। যেন কণ্ঠস্বর শহর ঘুরে এ বাড়ির ভেতর ঢুকেছে। মেয়েটার জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করেছে, মা।
বাবা বলে, আমার পাশে বস।
মেরিনা বাবার ঘা ঘেঁষে আদুরে ভঙ্গিতে বসে। মনে মনে ভাবে, সেই বয়সটা ফিরে পেলে লাফিয়ে বাবার কোলের ভেতরে ঢুকত। ও কাছে বসলে বাবা ওর মাথাটা কাত করে নিজের ঘাড়ের ওপর রাখেন।
কতক্ষণ পার হয়ে যায় তা কারও মনে থাকে না।
একসময় মেরিনা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, ঘুমোতে পারিনি কেন, জানো?
কেন রে? নতুন কোনো কথা মনে হয়েছে তোর?
আমার জেবুন্নেসার কথা খুব মনে হয়েছে। খুব ইচ্ছা হয়েছিল ওর চিঠিটা পড়ার। কিন্তু পড়তে পারলাম না। আমি অনেক ভেবে দেখেছি যে ওই চিঠিটা ভাইয়াকে দেওয়া আমার জন্য খুব কঠিন। শেষ পর্যন্ত আমি হয়তো পারব না দিতে।
আয়শা খাতুন নিজেও বিষণ্ণ কণ্ঠে বলেন, তুমি দিতে না পারলে আমি দেব, মা। মারুফের সঙ্গে ওর ভালোবাসার সম্পর্ক দিয়ে আমরা ওকে জেনেছি। ওকে আমার এই পরিবারের একজন মনে হচ্ছে। ওকে আমরা দেখিনি। কিন্তু ও দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছে। নির্যাতিত হয়ে জীবন দিয়েছে। তাতে কিছু এসে যায় না। ওর মৃত্যুই সত্য। ও আমাদের কাছে শহীদ। মারুফের জানা দরকার, যাকে ও ভালোবাসার কথা বলেছিল, তার সঙ্গে তার আর কেন দেখা হলো না। এই যুদ্ধের সময় তার কী হয়েছিল।
আয়শা খাতুন থেমে থেমে কথা বলছিলেন। একটি বাক্য শেষ করে আরেকটি বাক্য বলতে সময় নিচ্ছিলেন। তিনি যখন থামলেন, তখন মেরিনার কান্নার শব্দ শুনলেন। টের পেলেন আকমল হোসেনও চোখের জল মুছছেন।
তখন মধ্যরাত শেষ হয়েছে।
তারা পরস্পর হাত ধরেন। বাইরে রাস্তায় কোনো শব্দ নাই। মানুষ বা গাড়ির চলাচল নাই। বাড়ির পেছনের বুনো ঝোপে কয়েকটি জোনাকি জ্বলছে আর নিভছে। ঝিঁঝির শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। থেমে থেমে।
আকমল হোসেন এসবের মাঝে জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়ে বললেন, আজ রাতে আমরা না ঘুমাই?
আমারও তা-ই মনে হয়, আব্বা। আজ রাতে আমরা ঘুমাব না।