তিনি আবার শোবার ঘরে গিয়ে টেবিলে বসলেন। নিজের তৈরি ম্যাপের ওপর ঝুঁকে পড়ে গ্যানিজ ও ভোগ অপারেশনের রাস্তার হিসাব-নিকাশ করেন। অবাঙালিদের এই দোকান দুটো স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি যোগাযোগ ঘাটি। এখানে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চায় গেরিলারা। এই গেরিলারা ক্র্যাক প্লাটুন নামে পরিচিত। ক্র্যাক বললে বোঝা যায় তারা কারা। আর দুদিন পর ওরা শহরের রাস্তা তোলপাড় করে তুলবে। বলবে, দেখো, আমরা আছি।
সন্ধ্যার আগেই আয়শা খাতুন বাড়ি ফিরলেন। উফুল্ল হয়েই ফিরেছেন। আকমল হোসেনকে বললেন, যেখানে গিয়েছিলাম সেটা একটা দুর্গবাড়ি। ওই বাড়িতে একজন সিএসপি অফিসার থাকেন ঠিকই, কিন্তু গেরিলাদের জন্য ওটা একটা চমৎকার জায়গা। ওরা সুযোগমতো ওখানে যায়; খাওয়াদাওয়া করে। তারপর সুযোগমতো বেরিয়ে আসে। নিশাত আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওরা এলে মনে হয় দেবদূত এসেছে। যুদ্ধের সময়ও যে এত আলো থাকে, তা ভাবতে পারতাম না যদি ওদের সঙ্গে আমার দেখা না হতো।
যাক, আমাদের শহরের মধ্যেই আমরা ভিন্ন শহর গড়েছি। এটাই আমাদের সার্থকতা, আয়শা। রাস্তায় তোমার কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
না, রিকশাওয়ালা একটানে নিয়ে এসেছে। পথে আর্মির গাড়ি দেখেছি। দেখে মেজাজ খারাপ করেছি।
এটা মন্দ বলোনি। মেজাজ খারাপ করাটাও দরকার। মেজাজ খারাপ না হলে বুঝতে হবে আমরা থিতিয়ে গেছি। যাকগে। ওরা তোমাকে নিশ্চয়ই গান গাইতে বলেছে?
আয়শা খাতুন লজ্জিত ভঙ্গিতে বলেন, হ্যাঁ, বলেছে। ক্র্যাক প্লাটুনের ছেলে দুটো চা খাচ্ছিল। নিশাত ওদেরকে বুটের ডালের হালুয়া বানিয়ে দিয়েছিল। ওরা খাওয়া থামিয়ে বলল, খালাম্মা, বুকের ভেতর আপনার গানের ধ্বনি নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাই। শুধু দুটো লাইন গুনগুন করবেন—মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম—এই গানটি। আমি করলাম।
এটাই আমাদের যুদ্ধ, আয়শা। পরস্পরের গায়ে গায়ে থাকা। ওদের একধরনের কাজ; আমাদের অন্য ধরনের। কোনো কাজই খাটো করে দেখার নয়।
আমি কাপড় চেঞ্জ করে আসছি। তুমি ড্রয়িংরুমে বসো।
টেলিফোন বাজে। আকমল হোসেন ফোন ধরেন।
চাচা বলছেন?
বলো, বাবা।
আমি শাহাদাঁত। আমাদের হাতে কিছু অস্ত্র এসেছে। রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আজ রাতেই। আমরা আপনার বাড়ির কাছাকাছি আছি।
নিয়ে এসো আমার বাসায়। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোমরা কোনো দুশ্চিন্তা করবে না।
ফোন রেখে তিনি আলতাফকে ডাকলেন।
অস্ত্র রাখার জায়গা এ বাসায় ও-ই তৈরি করে। রাজমিস্ত্রির কাজ শিখেছে। মিস্ত্রি হওয়ার জন্য নয়। অস্ত্র লুকিয়ে রাখার জন্য কাজ শেখে। রং করার কাজও শিখেছে ও। বাড়িতে নানা ধরনের যন্ত্রপাতিও রাখা আছে। আলতাফ কাছে এসে দাঁড়ালে বললেন, অস্ত্র আসছে। রাখতে হবে। কোথায়?
আয়শা খাতুন শোবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, পেছনের বারান্দায়। ওখানে ভাঙাচোরা যে দুটো টেবিলচেয়ার আছে, সেগুলো সরিয়ে খোঁড়ার ব্যবস্থা করো। তারপর হেঁড়া মাদুর বিছিয়ে ঢেকে রাখা যাবে।
ঠিক বলেছ। তার ওপর ভাঙাচোরা টেবিল-চেয়ার রেখে দেব। মনে হবে, ভাঙাচোরা জিনিস ওখানে ডাম্প করা হয়েছে।
আরও বুদ্ধি আছে। ওখানে আমরা শুকনো লাকড়ির বোঝ রেখে দেব। আর্মি যদি এ বাড়িতে আসেও, তবু এসব জায়গা চিহ্নিত করতে পারবে বলে মনে হয় না।
আমারও তেমন ভরসা আছে। আলতাফ, তুমি কাজে লাগো।
সেটাই ভালো। খালাম্মা ঠিকই বলেছেন, স্যার। দরকারের সময় বুদ্ধি ঠিকই মাথায় আসে।
আকমল হোসেন নিজে ভাঙা চেয়ার-টেবিল দুটো সরিয়ে দেন। আলতাফ শাবল-কুড়াল-দা নিয়ে আসে। খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে। শব্দ যেন বেশি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখছেন আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন।
কখনো তাঁরা বারান্দার নিচে নেমে বাড়ির চারদিকে ঘুরে আসেন। কখনো গেটের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ান। বারান্দায় ওঠেন। ড্রয়িংরুমে আসেন। বসতে পারেন না কোথাও। প্রবল তাড়না তাঁদের স্থির থাকতে দেয় না। দুজনে দুদিকে প্রখর দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
আলতাফের খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভক্সওয়াগন গাড়িতে করে আসে শাহাদাঁত। আকমল হোসেন নিজেই গেট খুলে দেন। আবার বন্ধ করেন। অল্প সময়ের জন্য মুখ বাড়িয়ে রাস্তা দেখে নেন। গাড়ি গ্যারেজের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শাহাদাতের সঙ্গে নজরুল আর রতন এসেছে। সবাই মিলে বস্তা দুটো দ্রুত ঘরে ওঠায়। আলতাফ তখন একটি চার কোনা গর্ত করার কাজ শেষ করেছে। বস্তা দুটো অনায়াসে সেখানে রাখা যাবে।
আয়শা খাতুন তাগাদা দিয়ে বলেন, বস্তা দুটো তাড়াতাড়ি রেখে দাও। আলতাফকে আবার গর্তের মুখ বন্ধ করার কাজ করতে হবে। বাড়িতে অস্ত্র এলেই তার ভেতরে প্রবল অস্থিরতা কাজ করে। আজও তার মুখের দিকে তাকিয়ে মেরিনা বলে, আম্মা, আপনি ধৈর্য ধরেন। অস্ত্র তো, অনেক সময় তাড়াহুড়োয় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তার পরও সতর্কতার তো শেষ নেই, মারে।
আমরা অনেক সতর্ক। আপনি স্থির হয়ে বসেন। আব্বার সঙ্গে আমি থাকছি।
আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি বারান্দায় বসে গেট পাহারা দিই। তুই যা।
যোদ্ধারা অস্ত্রের বস্তা নিয়ে গর্তে ঢোকায়। সাবধানে পাশাপাশি খাড়া করে রাখে। আলতাফ গর্তের মুখ বন্ধ করার কাজ শুরু করে। মেরিনা চায়ের কথা বলতেই শাহাদাঁত আঙুল তুলে বলে, নো টি। আমরা তাড়াতাড়ি চলে যাই।
চলেন, আমি গেট খুলে দিচ্ছি। আব্বা তো এখানে থাকবেন। চোখের সামনে সবকিছু না দেখা পর্যন্ত আব্বার শান্তি নেই।