মারুফ বাতাসে উড়িয়ে দেয় কণ্ঠস্বর। বলে, এমনই হবে দেশজুড়ে। আর সবকিছুই যুদ্ধের সময়ের ঘটনা হবে। এখান থেকে কেউ কাউকে আলাদা করতে পারবে না।
একাত্তর এক অলৌকিক সময় হবে, না ভাইয়া?
হ্যাঁ, এক আশ্চর্য সময়ও বলতে পারবি। বলতে পারবি শ্রেষ্ঠ সময়ও।
উহ্, কী সাংঘাতিক, আমরা এই সময়ের মানুষ! এই জীবনে আমি আর কিছু চাই না।
খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকে মেরিনার চেহারা। ও দুহাতে মোটা-লম্বা বেণিটা খোলে আর গাঁথে। ওরা দুভাইবোন পাঁচজন গেরিলার জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা একসঙ্গে আসবে না। একেকজন একেক সময় আসবে। রাত দশটার মধ্যে ওদের আসা শেষ হবে। ওরা আজ রাতে এ বাড়িতে আসবে। থাকবে। পরদিন দিনের বেলায় এ বাড়িতে অপেক্ষা করবে। সন্ধ্যায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বোমা ফেলার কর্মসূচি আছে ওদের।
ভাবতেই রোমাঞ্চিত হয় মেরিনা। দ্রুত হাতে বেণিটা শেষ করে দুহাত কাজমুক্ত করে। ওরা এলে হাত দুটোকে কাজে লাগাতে হবে। সেই হাত দিয়ে বেণি বাধার কাজ করা যাবে না। কাজ করতে হবে যোদ্ধাদের জন্য। ওরা এলে প্রথমে চা-নাশতা দিতে হবে। যখন যে আসবে তখন তাকে। তারপর খাবারের টেবিলে খাবার সাজাতে হবে। ওদের ঘুমানোর জন্য বিছানা করতে হবে। মারুফের ঘরের মেঝেতে বড়সড় বিছানা পেতে সবাই একসঙ্গে ঘুমোবে বলে ঠিক করেছে। সেই অনুযায়ী তোশক-বালিশ তৈরি রাখা হয়েছে।
মারুফ কান খাড়া করে বলে, বাবা বোধ হয় আমাকে ডাকছেন। শুনে আসি কী বলবেন।
এক মিনিট দাঁড়াও, ভাইয়া। একটা কথা—
কী বলবি? মারুফের ভুরু কুঁচকে থাকে।
তাহলে আজ রাতে শুরু, ভাইয়া?
হ্যাঁ, আজ রাতেই প্রস্তুতি শেষ হবে। কাল আমরা নিজেদের চিন্তামুক্ত রাখব। তাস খেলব। ক্যারম খেলব। মাকে খিচুড়ি রাঁধতে বলব। আর বাবাকে ডেকে তার ছাত্রজীবনের গল্প শুনব। আমরা মনে করব, সময় আমাদের জীবনে পাখা মেলেছে। ওটা দম আটকে মুখ থুবড়ে পড়েনি।
ওরা কখন আসবে?
মেরিনার কণ্ঠ অস্থির শোনায়।
যখন তখন। এক্ষুনি বা তক্ষুনি।
মেরিনা মৃদু হেসে বলে, বেশ সুন্দর করে উত্তর দিলে। তুমি তো নির্দিষ্ট করে জানো না যে কখন আসবে।
আসার পথ খুব সহজ নয়তো, সে জন্য এভাবে বলা।
বুঝেছি। চলো, বাবার ঘরে যাই।
দুজনে উঠে দাঁড়ানোর আগেই আকমল হোসেন ড্রয়িংরুমের দরজায় এসে দাঁড়ান।
আব্বা, আমরাই তো যাচ্ছিলাম।
আমিই চলে এলাম। তোদের কথা আমি শুনতে পাচ্ছি। তোরা আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না। কিসের যুক্তিতক্ক হচ্ছিল?
পাঁচজন গেরিলা আসবে, বাবা!
হ্যাঁ, তা তো জানি। আমি ওদের আসার পথের ম্যাপ করছিলাম।
কই, দেখি তোমার কাগজটা।
না, তোদের হাতে দেওয়া যাবে না। আমি তোদের বোঝাব। তোদের মাকে ডেকে নিয়ে আয়।
আমাকে ডাকতে হবে না। আমি এসে পড়েছি।
আঁচলে হাত মুছতে মুছতে আয়শা খাতুন ঘরে এসে ঢোকেন। আগুনের আভায় তাঁর ফরসা দুগাল চকচক করছে। কপালে ঘাম জমে আছে।
হ্যাঁ, এখানে বসেন। এই সোফায় আমি আর আপনি। পাশের সোফায় আব্বা আর মেরিনা।
আপনার রান্না শেষ হয়েছে, মা?
হয়েছে, বাবা। সব শেষ করেই রান্নাঘর থেকে বের হয়েছি রে।
কী বেঁধেছেন? খাওয়ার লোভ জিবে টিকিয়ে রাখার জন্য জিজ্ঞেস করছি, মা।
বেঁধেছি মুরগি আর ইলিশ মাছ। ডাল, ঢ্যাঁড়শ ভাজি। শুটকি মাছের ভর্তা। কাউন চালের পায়েস করেছি।
উহ্, এত কিছু! খাবার টেবিল আজ দারুণ জমবে।
ছেলেরা ভালো-মন্দ না খেলে যুদ্ধ করবে কী করে! ওদের যুদ্ধ আমাদেরও করতে হবে।
আকমল হোসেন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, খাইয়েদাইয়ে ছেলেদের আয়েশি করা যাবে না। পরে ওরা বলবে ঘুমপাড়ানি গান গাও, মা। ঘুমিয়ে পড়ি।
পাগল, ওরা কখনো এমন কথা বলবে না।
না বললে ভালো।
যারা যুদ্ধ করার জন্য পথে নামে, তাদের সহজে ঘুম আসে না। ওরা ঘুমপাড়ানি গানের তোয়াক্কা করে না।
তুমি রেগে গেলে দেখছি।
তুমি বলতে চাও এখন আদর দেওয়ার সময় না?
হ্যাঁ, তা-ই। আকমল হোসেনের কণ্ঠস্বর গম্ভীর এবং কঠিনও। আমি ছেলেদের বাড়াবাড়ি প্রশ্রয় দিতে চাই না। সেটা কোনো ধরনের আচরণেই না। সেটা খাওয়াদাওয়াতেই হোক বা রাস্তায় হাঁটাতেই হোক।
আয়শা খাতুন নিরেট কণ্ঠে বলেন, ঠিক আছে, এরপর ওরা যখন আসবে, তখন আমি ওদের আটার রুটি আর এক বয়াম আচার দেব। ওই খেয়েই ওদের গায়ে বল হবে।
মেরিনা মায়ের হাত চেপে ধরে আতঙ্ক নিয়ে বলে, না মা, না। আপনি এমন করবেন না। আপনি যা খাওয়াতে চান, তা-ই খেতে দেবেন। অপারেশনে গিয়ে ওদের কেউ যদি ফিরে না আসে, তখন ওর অন্য বন্ধুরা বলবে, ও মৃত্যুর আগে মায়ের আদর পেয়েছিল। দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। ও বীর শহীদ। ইতিহাস ওকে মনে রাখবে।
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আয়শা খাতুন ড়ুকরে কেঁদে ওঠেন। কাঁদে মারুফ আর মেরিনাও। শুধু আকমল হোসেন নিজের হাতের কাগজটি টেবিলে বিছিয়ে রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখেন। যুদ্ধের নিরেট সত্যে তার মগজ থমথমে। ওখানে আবেগের জায়গা নেই। কঠিন স্বরে ডাকেন, মারুফ।
জি, আব্বা।
তুমি একজন গেরিলাযযাদ্ধা। মেলাঘরে গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছ।
জি, আব্বা।
তাহলে এমন ভেঙে পড়েছ কেন? যুদ্ধে প্রশ্রয়ের বাড়াবাড়ি থাকে না। মায়ের চোখের পানিও তাকিয়ে দেখতে হবে না। তুমি এখন গ্রেনেড, স্টেনগান, প্রয়োজনে আরও বড় অস্ত্র। যুদ্ধের সময় তোমার শরীর তোমার নয়।
আব্বা! মেরিনার ভয়ার্ত কণ্ঠ ঘরের ভেতর ধ্বনিত হয়। ওর শরীর কার, আব্বা?