আকমল হোসেন নিজ ঘরে এসে টেবিলে বসেন। আজকের অভিজ্ঞতার বিবরণ ডায়েরিতে লেখেন। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার দুর্গবাড়িগুলোর ঠিকানা তিনি ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। পুরো তালিকা নিয়ে তিনি একটি বড় কাগজে ম্যাপ বানিয়েছেন। রাস্তাসহ বাড়ির স্থান চিহ্নিত করে লাল কালি দিয়ে গোল গোল দাগ করেছেন। সে জন্য একটি বাড়ির অবস্থান তিনি অনায়াসে বুঝে নিতে পারেন। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জায়গার ম্যাপ আঁকা তিনি খুব পছন্দ করেন। এ ম্যাপ গেরিলাদের কাজেও লাগে। ওদের অপারেশনের আগে তিনিও রেকি করেন। আয়শা খাতুন যে বাড়িতে গেছেন, সেটি একটি সরকারি বাসভবন। আমিরুজ্জামান সরকারি চাকুরে। তার ভাই গেরিলা। শরীরে মুক্তিযোদ্ধার টগবগে রক্ত। দারুণ সাহসী।
আকমল হোসেন মৃদু হেসে টেবিল থেকে উঠলেন। এভাবে ভাবলে তিনি পুরো ছক নিয়ে রাত পার করে দিতে পারবেন। সবটাই তার নখদর্পণে। তিনি চেনেন সবাইকে। ফার্মগেটের দিকে একটি ঘাটি করার জন্য ছেলেদের পরিকল্পনা আছে। সেটা নিয়েও তিনি ভাবছেন। ওখানে একটি বাড়ি ভাড়া করতে হবে। যত দিন যাচ্ছে, তত গেরিলা তৎপরতা বাড়ছে। দলে দলে ছেলেরা ঢুকছে ঢাকায়। সাঁড়াশির মতো আক্রমণ করবে ওরা—চারদিক থেকে আক্রমণ। ওদের মুখের দিকে তাকালে আকমল হোসেন নিজের বয়সের কথা ভুলে যান। মনে হয়, তিনি ওদের বয়সী। এমন একটি ভাবনা এ যুদ্ধের সময় তার জন্য এক গভীর আনন্দের ব্যাপার। তিনি কিছুক্ষণ রেস্ট করবেন বলে বিছানায় শুয়ে পড়েন। মুহূর্তে চোখ বুজে আসে।
পাঁচটার পরে মেরিনার ডাকে ঘুম ভাঙে তাঁর। সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলেন। কোনো এক সাগরপাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। কখনো সঙ্গে আয়শা, কখনো মারুফ, কখনো মেরিনা। কিন্তু সবাই একসঙ্গে নয়। মেরিনার উচ্ছ্বাস সবচেয়ে বেশি। বারবারই বলছিল, আব্বা, ওই দেখেন, পাখিটা কী সুন্দর! ইশ, ওই ফুলটা ছিঁড়ে আনি! সাগর আর মেঘের এমন বন্ধুত্ব আমি কোনো দিন দেখিনি। মারুফ বারবার সাগরে নেমে পা ভিজিয়ে আসছিল। বলছিল, পৃথিবীর কোন স্বর্গ এই জায়গা! আয়শা খাতুন খানিকটা চুপচাপ ছিল। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। তিনি আয়শার হাত ধরে বলেছিলেন, কী হয়েছে তোমার? আয়শা ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলেছিল, জানি না। মেরিনার ডাকে ঘুম ভেঙে গেলে তিনি বিষণ্ণ বোধ করেন।
আব্বা ওঠেন। ফয়সল আর নাসিম এসেছে। আপনার গভীর ঘুম দেখে আমি অনেকক্ষণ ডাকিনি। আমার মনে হচ্ছিল, আপনি সুন্দর স্বপ্ন দেখছেন।
তিনি চোখ খোলেন। মেয়েকে দেখেন। বাবার হাত ধরে নাড়িয়ে দিয়ে মৃদু হাসে মেয়ে।
তুই ওদের সঙ্গে কথা বল। আমি আসছি।
মেরিনা রান্নাঘরে ঢুকে কেটলিতে চায়ের পানি চুলোয় বসিয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। ওরা দুজন নিচুস্বরে কথা বলছিল। মেরিনাকে ঢুকতে দেখে বিব্রত হয়ে বলে, যুদ্ধের সময় আমরা আস্তে কথা বলার অভ্যাস করেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। ঘরের ভেতরও অভ্যাস রয়ে গেছে।
কী যে বলো না, ফয়সল! এ সময় এত কিছু ভাবারও সময় নেই আমাদের। কত ধরনের কাজ নিয়ে আমরা ঘুরছি। তোমরা তো কাজ নিয়েই এসেছ। আড্ডা দিতে তো নয়। আব্বা এখনি আসবেন।
আকমল হোসেন ঘরে ঢোকেন। হাসিমুখে বলেন, কেমন আছ তোমরা?
আমরা ভালো আছি, চাচা।
তোমাদের পরিকল্পনার কথা শুনে ভালো লেগেছে। গেরিলা নামটিও আমার পছন্দ হয়েছে। কীভাবে করবে পত্রিকা?
সাইক্লোস্টাইল করে ছাপব। ট্যাবলয়েড সাইজ। আমাদের বন্ধুরা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবে। আমরা চাই, দেশে যারা আছেন, তারা যুদ্ধের খবরাখবর পাবেন এবং মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে সচেতন থাকবেন। আপনাকে প্রতি সংখ্যায় লিখতে হবে, চাচা।
অবশ্যই লিখব। তোমরা উদ্যোগ নিয়েছ আর আমি তার সঙ্গে থাকব না, তা কি হয়! তবে আমার মনে হয়, যারাই লিখবেন, তাঁদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা ভালো। আমি ভেবেছি, শান্তি কমিটি, সেনাবাহিনী, সরকার ইত্যাদি বিষয়ে খুঁটিনাটি খবরাখবর দেব। তাদের অবস্থান, তাদের প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ দেব। ঢাকা শহর যেন তোমাদের পত্রিকায় নানা দিক নিয়ে উপস্থিত থাকে।
হ্যাঁ, খুব ভালো হবে, চাচা। আমরা শহরকে সবার সামনে ছবির মতো রাখতে চাই। প্রতিটি ঘটনার বিবরণ তারা পাবেন আমাদের পত্রিকা থেকে।
ছেলেদের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে আকমল হোসেন ভাবেন, এই যুদ্ধের সময়েও বেঁচে থাক এমন সাহসী অসংখ্য তরুণ। ওদের পরিকল্পনায় হাজারো স্বপ্নের ফুলকলি ফুটে উঠছে।
মেরিনা ওদের চা-পায়েস খেতে দেয়। ওদের চলে যাওয়ার সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলে। যেন কথার শেষ নেই। কথার রেশ ধরে এগিয়ে আসছে কাজ, কাজের পর থাকবে ফলাফল। মারুফ যাওয়ার পরে মেয়েটি এ বাড়ির হাল ধরে রেখেছে। গেরিলাদের যোগাযোগ ওর সঙ্গেই। ও জানে বাড়ির কোন পয়েন্ট থেকে কাকে বের করে দিতে হবে, কোন পয়েন্ট থেকে ঢোকাতে হবে। নতুন আর পুরোনো শহরের মাথায় বাড়িটির অবস্থান হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সহজ যোগাযোগ ছিল এ বাড়ির সঙ্গে। ওরা বলে, পুরান ঢাকা আর নতুন ঢাকার যোগাযোগের সেতুবন্ধ এই বাড়ি। আমাদের খুব সুবিধা হয়। আজও মেরিনা ফয়সল আর নাসিমকে বাড়ির দ্বিতীয় এন্ট্রি পয়েন্ট দিয়ে বের করে দিল। মোট চারটি এন্ট্রি পয়েন্ট আছে বাড়িটির। আলতাফ পুরো বাড়ির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে। আকমল হোসেন ভাবলেন, সময়ই সবচেয়ে বড় বন্ধু। সবাইকে এক সুতায় গেঁথে রেখেছে।