ঠিক, ঠিক বলেছ। এমন কথা শুনলে আমার মনে হয়, আমার আয়ু বেড়ে যাচ্ছে।
আয়শা খাতুন আবেগে আকমল হোসেনের দুহাত জড়িয়ে ধরলে তিনি বলেন, শুধু হাত কেন? এসো। তিনি আয়শা খাতুনকে জড়িয়ে ধরে তার মাথার ওপর নিজের থুতনি রেখে বলেন, আমরা যুদ্ধের সময়ের সাক্ষী। এ সময়ের দলিলগুলো আমাদের গুছিয়ে রাখতে হবে।
আয়শা খাতুন অনুভব করেন, যুদ্ধের সময়ও এ মানুষটির বুক প্রবল ওমে ভরা। এ মানুষটি জেবুন্নেসার জন্য কেঁদেছেন। বলেছেন, ওকে শহীদের মর্যাদায় স্মরণ করবে। ওর মৃত্যুর তারিখ ডায়েরির পৃষ্ঠায় লিখে রেখেছেন। বলেছেন, আয়শা, আমরা যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন ওর মৃত্যুদিনে একটি মোমবাতি জ্বালাব। আর পথের পাঁচটি বাচ্চাকে ডেকে এনে খাওয়াব। ওদের জেবুন্নেসার কথা বলব। পারবে না, আয়শা?
আয়শা নিজেও কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলেছেন, পারব না কেন, আমাদের পারতেই হবে। আমরা না পারলে মুছে যেতে থাকবে জেবুন্নেসাদের ইতিহাস।
সেদিনও প্রবল আবেগে আকমল হোসেন আয়শা খাতুনকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আজও দুজনের ওমভরা শরীর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রাখে। পুরো ঘরে এখন ওমভরা সময়। যুদ্ধের সময়। যে যুদ্ধ স্বাধীনতার জন্য। দুজনে অনেকক্ষণ একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। ভাবেন, তাঁদের বিবাহিত জীবনের সাতাশ বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু এমন ওমে ভরা সময় আসেনি। এই অন্য রকম সময় দুজনকে নিবিড় ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়।
খাবার টেবিলে মেরিনা বলে, আব্বা, ফয়সল ফোন করেছিল।
কী বলেছে? কোনো পরিকল্পনা?
বলেছে, ওরা গেরিলা নামে একটি পত্রিকা বের করবে। আপনাকে লিখতে হবে। বলেছে, ওরা ইংরেজিতে বের করবে। বেশির ভাগই যুদ্ধের খবরাখবর থাকবে। ঢাকায় বসবাসকারী বাঙালিরা যেন সব ধরনের খবর পায়, সে চেষ্টা করবে। আর যুদ্ধের খবর বেশি থাকবে। লিখবেন তো, আব্বা?
বলিস কী, মা! লিখতে তো হবেই। না লিখলে নিজের সঙ্গে নিজেরই বেইমানি করা হবে।
বুঝেছি। এই সময় আপনার কাছে সব কাজই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমি এমন বাবা পেয়ে গর্বিত।
আয়শা খাতুন মৃদু হেসে বলেন, আর মা?
মা-ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাগো, আপনার গানের ধ্বনি তো একটা রণক্ষেত্র।
এমন আলোচনায় খাবার টেবিল অন্য রকম হয়ে যায়। মন্টুর মা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কী কথা হচ্ছে, সেটা বুঝতে চায়। বোঝেও। একইসঙ্গে নিজেকে বলে, মেরিনা মন্টুর মায়ের জন্য গর্ব হয় না? মন্টুর মা-ও তো গর্বের মানুষ হতে চায়।
মায়ের সঙ্গে কথা বলে আকস্মিকভাবে মন্টুর মায়ের দিকে তাকায় মেরিনা। চোখ বড় করে বলে, আপনি আমার কাছে আসেন। চেয়ারের কাছে। আমি আপনার হাত ধরব। মন্টুর মা এগিয়ে এলে মেরিনা বলে, আপনার জন্যও আমার গর্ব হয়, খালা। আপনি যুদ্ধকে নিজের করে নিয়েছেন।
মন্টুর মা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বলে, যাই।
মেরিনা মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসে। বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, আব্বা, ফয়সল আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য আসতে চেয়েছে।
ফোন করে দে। পারলে আজ বিকেলে আসুক।
আচ্ছা, বাবা। মেরিনা খুশি হয়ে ঘন ঘন মাথা নাড়ে। বলে, বাবা, আমি ঠিক করেছি ওদের সঙ্গে কাজ করব। ওরা আমাকে বাড়ি বাড়ি পত্রিকা বিলি করার দায়িত্ব দিয়েছে। পত্রিকার কপি ঢাকার সব বিদেশি অফিসে পাঠানো হবে।
গুড। এটা খুব দরকার। বিশ্বের সবাইকে অনবরত জানাতে হবে—আমরা আছি। আমরা বসে নেই।
তুমি ডালের স্যুপটা খাও। আজ তুমি তোমার প্রিয় স্যুপ খেতে ভুলে গেছ।
আয়শা খাতুন মৃদু হেসে বলেন, আজ আমি বের হব। অনেক দিন বের হইনি।
কোথায় যাবে? কারও সঙ্গে কথা হয়েছে?
ঢাকা শহরের দুর্গবাড়ি তো শুধু আমরা নই, আরও আছে না। শায়লা আপা ফোন করেছিলেন। এলিফ্যান্ট রোডে যেতে হবে। বলেছেন, জরুরি কথা আছে।
বুঝেছি। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসব?
না, আমি রিকশায় যাব। একটু পরেই ফিরে আসব। তুমি তো বাড়িতেই আছ?
হ্যাঁ, আমি আর বের হব না। চলো, উঠি।
তখনই টেলিফোন বাজে। ছুটে যায় মেরিনা।
হ্যালো, ও ভাইয়া। তুমি তো এলে না। বাবা তোমার জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন।
আমরা বায়তুল মোকাররমের সামনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আব্বা-আম্মা কই?
দুজনেই ততক্ষণে টেলিফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ফোন ধরেন আকমল হোসেন।
হ্যালো, বাবা।
আব্বা, আমরা সকালে বায়তুল মোকাররম যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করেছি। জুমার নামাজের পর শান্তি কমিটির মিছিল হবে সে জন্য। আমরা রিস্ক নিতে চাইনি। অন্য সময় রেকি করা হয়েছে।
ঠিক করেছ। তবে তোমার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে আমার ওদের কর্মসূচি দেখার সুযোগ হয়েছে। তুমি মন খারাপ কোরো না। সকালে যা দেখেছি, তার সবকিছু ডায়েরিতে লিখছি। একজন ফেরিওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়েছে, যে যুদ্ধে যাবে বলেছে।
আব্বা, গ্যানিজ ও ভোগ অপারেশনের সব প্রস্তুতি আমাদের শেষ হয়েছে।
দোয়া করি। তোমাদের জন্য দোয়া করি।
আম্মাকে আমার সালাম দেবেন।
ফোন রেখে দেয় মারুফ। মেরিনা নিজের ঘরে যায়। আয়শা খাতুন রান্নাঘর তদারকিতে ঢোকেন। আকমল হোসেন ভাবেন, তিনি নিজেও দু-এক দিনের মধ্যে ধানমন্ডি যাবেন। ওখানকার দুর্গবাড়িটিও গেরিলা অপারেশনের নানা দিক দেখাশোনা করে। ওই বাড়ির সাতটি ঘরের পাঁচটিতেই ঢালাও বিছানা পাতা আছে গেরিলাদের জন্য। ওই বাড়ির দুই ছেলে যুদ্ধে গেছে। তাদের বড় ছেলে পঁচিশের রাতের পরে তার কলেজের শিক্ষককে পরিবারসহ নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, মা, আমার শিক্ষক হিন্দু। তাদের চার মেয়ে। তাদের এ বাড়িতে থাকতে দাও। নিজের ইচ্ছায় কোথাও না যেতে পারলে তাদের তুমি যেতে বলবে না। আমি জানি, বাবা-মাসহ চার মেয়েকে রাখার সামর্থ্য তোমার আছে, মা। সেই থেকে প্রদীপ সাহার পরিবার ওই বাড়িতে আছে। ছেলেটি সেই যে গেল আর আসেনি। ওর বাবা-মা খবর পেয়েছে যে, ছেলেটি ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করছে। যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া বাড়িগুলো পরস্পর যুক্ত। একে অপরের খোঁজখবর রাখে। একটু পরে আয়শা খাতুন বেরিয়ে যান।