মোতালেব হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারপর নিজেই গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়। আকমল হোসেন গাড়িতে স্টার্ট দেন। বুকের ভেতর শান্তি কমিটি কাঁটার মতো বিধে থাকে। প্রথম বৈঠকের পর যেদিন ওরা শহরের পথে মিছিল করেছিল, সেদিনও তিনি দূরে দাঁড়িয়ে ওদের মিছিল দেখেছেন। সেদিনও মিছিল বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে চকবাজার মসজিদ হয়ে নিউ মার্কেটের মোড়ে গিয়ে শেষ হয়েছিল। মিছিলে বিহারিদের সঙ্গে বাঙালি দালালেরাও ছিল। মিছিলে ব্যান্ড পার্টি ব্যবহার করা হয়েছিল। যেন উৎসব, এমন ভাব। পাকিস্তানের পতাকাসহ ব্যানার-ফেস্টুন বহন করেছিল মিছিলকারীরা। ইয়াহিয়া, আইয়ুব, জিন্নাহ, ফাতেমা জিন্নাহ, এমনকি আল্লামা ইকবালের ছবিসহ প্ল্যাকার্ড ছিল ওদের হাতে। সেদিন বৃষ্টি ছিল। তার পরও মিছিলকারীরা কোথাও থামেনি। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে শেষ করেছিল নির্ধারিত স্থানে গিয়ে। সেখানে বক্তৃতা করেছিলেন খাজা খয়েরউদ্দিন। মোনাজাত পরিচালনা করেছিলেন গোলাম আযম। গাড়ি নিয়ে এসব দেখার জন্য সেদিন তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছিলেন।
কয়েক দিন পর পত্রিকায় পড়েছিলেন খাজা খয়েরউদ্দিনের প্রচারিত প্রেস রিলিজ। সেখানে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিরা সারা প্রদেশে সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হওয়ায় এখন পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছে। শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের হত্যা করছে। যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেনাবাহিনী দেশকে খণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য লড়াই করছে। তাদের সাফল্যের জন্য কমিটি আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করছে।
আকমল হোসেন এ স্মৃতি মনে করে হা-হা করে হাসেন। রাস্তায় গাড়ি তখন লাল বাতির সামনে থেমে গেছে।
আকমল হোসেনের হাসি শুনে আলতাফ পেছন থেকে ডাকে, স্যার।
ওদের প্রেস রিলিজের কথা মনে করে হাসছি। ওরা নিজেরা যে নিজেদের ফাঁদে পা ঢুকিয়েছে, তা ওরা বুঝতে পারে না। ওরা মনে করছে, ওরা সাফল্যের মধ্যে আছে।
আমিও এটা মনে করি, স্যার। ওদের আনন্দের ড়ুগড়ুগি শুনলে আমার হাসি পায়।
ভেবে দেখো, ওরা কী বলছে? বলছে রাষ্ট্রবিরোধীরা শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের হয়রানি করছে। মানে গেরিলারা অপারেশন চালাচ্ছে—এর অর্থ তো তা-ই দাঁড়ায়।
ঠিক, স্যার।
রেড লাইট সিগন্যাল শেষ হয়েছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে তিনি বলেন, ওরা বলছে, সেনাবাহিনী দেশকে খণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করছে। স্বাধীনতাযুদ্ধকে স্বীকার করার বাকি থাকল কী? বিদেশের মানুষেরা এত বোকা না যে এর মর্ম বোঝে না।
আবার তিনি হো-হো করে হাসেন। আলতাফের মনে হয় স্যারের মনে আজ খুব ফুর্তি। সামনে আরেকটি গেরিলা অপারেশন হবে—এ আনন্দে তিনি আছেন। গাড়ির দরজা খোলার আগে তিনি বলেন, আলতাফ, আমাদের বাড়িতে রাখা অস্ত্রগুলো আজ চেক করতে হবে। তুমি অন্য কোথাও যেয়ো না।
না স্যার, কোথাও যাব না। এখন তো আপনাকে না বলে কোথাও যাই না। আমার সময়টাও এখন যুদ্ধ, স্যার। রাত-দিন মনে করি দেশের জন্য কিছু করতে হবে। আমার যা সাধ্য ততটুকু, সাধ্যের বাইরে যদি কিছু করতে হয়, তা-ও করব।
থ্যাংকু, আলতাফ। তোমার কাজ করার ইচ্ছা আমাদের শক্তি। আমরা কখনো পেছাব না।
আলতাফ গাড়ি থেকে নেমে দরজা খোলে। গাড়ি ঢুকে যায় ভেতরে। গ্যারেজে ঢোকে। এ গ্যারেজের মেঝে খুঁড়ে গেরিলাদের গোলাবারুদ রাখা হয়েছে একটি টিনের বাক্সে। রান্নাঘরের ফলস ছাদে আছে। স্টোররুমে আছে। ছাদের ওপরে পানির ট্যাংকে আছে। এসব কিছুর নজরদারি করেন আকমল হোসেন। কখন, কীভাবে, কোথায়, কাকে, কী দিতে হবে তার সবকিছু তিনি নিজে দেখাশোনা করেন। কোথায় কী আছে তা তার নখদর্পণে। আয়শা খাতুন স্বামীর এই ক্ষিপ্র কাজে কখনো খুব বিস্মিত হন। সঙ্গে থাকে বাড়ির অন্যরা। গাড়ি থেকে নেমেই দেখলেন, আয়শা খাতুন আর মেরিনা সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
আয়শা খাতুন উদ্গ্রীব কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, মারুফের সঙ্গে দেখা হয়েছে তোমার?
হয়নি। ছেলেটি তো এল না! বেশ অনেকক্ষণই তো অপেক্ষা করলাম।
হয়তো কোথাও আটকা পড়েছে। হবে হয়তো।
নয়তো ওদের রেকি করার কৌশলে কোনো চেঞ্জ হয়েছে।
সবাই মিলে ঘরে ঢোকেন।
আব্বা, আপনি কিছু খাবেন? শরবত দেব?
এখন কিছু লাগবে না। গোসল করে নিই, একবারে ভাত খাব। তুই ঠিক আছিস তো, মা?
কেন, আব্বা? আমি তো সুস্থ আছি। আপনি কেন ভাবলেন আমার কিছু হয়েছে?
ভুলে যেতে পারি না যে এটা যুদ্ধের সময়। যেকোনো সময় যা কিছু হতে পারে, কে জানে, মা। তুমি টেবিলে খাবার রেডি করো, আমি আসছি।
আকমল হোসেনের সঙ্গে সঙ্গে আয়শা খাতুনও শোবার ঘরে আসেন। জিজ্ঞেস করেন, বায়তুল মোকাররমে কী দেখলে? শহরের পরিস্থিতি কী?
পাকিস্তানের পতাকা হাতে শান্তি কমিটির মিছিল দেখেছি এবং পাশাপাশি একজন মানুষ পেয়েছি, যে আমাকে বলেছে, সে যুদ্ধে যাবে। বলেশ্বর নদীর ধারের লোক। বুঝতে পারছি, ওর যুদ্ধক্ষেত্র ৯ নম্বর সেক্টর হবে।
আয়শা খাতুন মৃদু হেসে বলেন, তোমার আজকের দেখা দারুণ। পাকিস্তানের পতাকা হাতে স্বাধীনতাবিরোধীদের মিছিল এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা।
হ্যাঁ, আয়শা। ঠিক বলেছ। দুটিই যুদ্ধের সময়ের চিত্র। দুটিই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, একদিন দেশ স্বাধীন হবে এবং একদিন স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার হবে। অপরাধের দণ্ড ওদের পেতেই হবে।