যাওয়ার আগে আলতাফ জিজ্ঞেস করে, যাবেন না, স্যার? আর কতক্ষণ থাকবেন?
আর কিছুক্ষণ পর যাব। ছেলেটা যদি আমাকে এসে না পায়, তাহলে মন খারাপ করবে।
এখনই হয়তো নামাজ শেষ হবে।
সমস্যা কী? মুসল্লিরা যে যার পথে চলে যাবেন।
ভিড় হবে, স্যার। আর সময় তো ভালো না। আমরা তো শত্রুপক্ষ।
ঠিক আছে, তুমি যাও। আমি আসছি।
তিনি ফলের টাকা দিতে দিতে চারদিকে তাকান। কোথাও মারুফ নেই। তার মন খারাপ হয়। শুধু মানসিক নয়, শারীরিকভাবেও বিষণ্ণ বোধ করেন। পরক্ষণে সচেতন হয়ে ওঠেন। এবং নিজেকে ধমকান, এভাবে ভাবা ঠিক নয়। এটা যুদ্ধের সময়।
তখন মসজিদ থেকে স্রোতের মতো মানুষ বের হয়। তিনি একমুহূর্ত দাঁড়ান। দেখতে পান, সবার আগে বেরিয়ে আসছেন খাজা খয়েরউদ্দিন। এপ্রিল মাসে গঠিত হয়েছে শান্তি কমিটি। এই কমিটি শহরের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখবে। শহরের পরিস্থিতি আগের অবস্থায় নিয়ে আসবে। তাদের অনেক কাজ। আকমল হোসেন মৃদু হাসলেন। আর দুদিন পর শহরবাসী বুঝবে, স্বাভাবিক অবস্থা কী! তা ফিরিয়ে আনার সুযোগ ওদের জীবনে আর আসবে না। খাজা খয়েরউদ্দিন শান্তি কমিটির আহ্বায়ক। আকমল হোসেন দেখলেন, খয়েরউদ্দিন উত্তেজিত স্বরে কথা বলছেন। তাঁর অনুসারীদের কিছু বোঝাচ্ছেন। আকমল হোসেন স্মৃতি হাতড়ে দেখলেন, যেদিন শান্তি কমিটি গঠিত হয়, সেদিন টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি খুঁটিয়ে কাগজ পড়ে এসব বিষয় একটি পুরোনো ডায়েরিতে লিখে রাখেন, যেন ভুলে না যান সে জন্য। আজও দেখতে পেলেন মিছিলের তোড়জোড় চলছে।
একটু পর খয়েরউদ্দিনের নেতৃত্বে মিছিল শুরু হয়। শুনতে পান বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে চকবাজার মসজিদ পর্যন্ত মিছিল যাবে। তিনি পেছনে সরে আসেন। একজন হুড়মুড়িয়ে নামতে নামতে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলে, থু, বাঙালি গাদ্দার।
তিনি শুনে অন্যদিকে তাকান। কোনো ভাবান্তর প্রকাশ করেন না। তিনি আরও দুপা পিছিয়ে আসেন। পরে আরও অনেকখানি। ততক্ষণে মিছিল গুলিস্তানের রাস্তায় উঠেছে। নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে চারদিক। ওদের হাতে ব্যানার-পোস্টার। নানা স্লোগানে ওরা একটি বিদ্বেষপূর্ণ বার্তায় চারদিক তোলপাড় করছে।
আকমল হোসেন মনে করলেন, শান্তি কমিটির প্রথম সভায় যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল তার মধ্যে ছিল—এই সভা মনে করে যে, হিন্দুস্থান পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দেশপ্রেমিকতার প্রতি চ্যালেঞ্জ করছে। শেষ সিদ্ধান্তটি ছিল—এ সভা আমাদের প্রিয় দেশের সম্মান ও ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশপ্রেমিক জনগণকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আকুল আহ্বান জানাচ্ছে।
দেশপ্রেমিক জনগণের মিছিল যাচ্ছে। চারদিকে পাকিস্তান রক্ষায় জীবনদানকারী হয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দেশপ্রেমিকেরা। ভালোই তো, দেখা যাবে ওরা কতটা খাঁটি। আকমল হোসেন চোখের ওপর ডান হাত রেখে রোদ আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকেন। মিছিলের শেষ মানুষটিকে তখন আর দেখা যাচ্ছে না। তিনি ফেরার কথা ভাবলেন। পেছনে ফিরলে দেখতে পান, একজন ফেরিওয়ালা তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ফিরতেই লোকটি বলে, স্যার, ওরা আপনাকে গাদ্দার বলেছে। আপনি কিছু বললেন না কেন, স্যার?
ও তো ঠিকই বলেছে। ওর চিন্তায় আমি তো তা-ই। তিনি নির্বিকার কণ্ঠে উত্তর দেন। মৃদু হাসেন।
গাদ্দার মানে কী, স্যার?
বিশ্বাসঘাতক।
লোকটি চমকে উঠে বলে, বিশ্বাসঘাতক! কী বলে ওরা? বিশ্বাসঘাতক! আপনি কি বিশ্বাসঘাতক, স্যার?
হ্যাঁ, বিশ্বাসঘাতক তো বটেই।
কেন, স্যার? কেন?
কারণ আমি বাঙালি, সে জন্য। আমরা ওদের মুখোশ খুলে দিতে চাই। বলে।
নেমে যায় লোকটির কণ্ঠস্বর। বলে, ও, এই। আমিও তো বাঙালি। আমার বাড়ি বলেশ্বর নদীর ধারে। গ্রামের নাম মাছুয়া। মহকুমা পিরোজপুর। জেলা বরিশাল।
বাহ, তুমি তো একদম খাঁটি বাঙালি। ব্র্যাভো।
কিন্তু আমি বিশ্বাসঘাতক না। আমি বিশ্বাসঘাতক হব কেন? এটা আমার জন্মভূমি।
ওরা তো আমাদের বিশ্বাসঘাতক বলবেই।
কেন, স্যার? আমরা কী করেছি?
আমরা স্বাধীনতা চাই। স্বাধীন দেশ চাই। ওরা যা বলে বলুক। আমার তাতে কিছু এসে যায় না। আমরা যুদ্ধ করছি।
সে জন্য বিশ্বাসঘাতক শুনে আপনার খারাপ লাগেনি।
হ্যাঁ, তাই। তুমি যে ব্যাপারটা বুঝেছ সে জন্য আমার ভালো লাগছে।
আমি তো ভেবেছিলাম আপনি লোকটিকে ঘুষি মারলেন না কেন? কুত্তার বাচ্চা বলে কী!
আস্তে কথা বলো।
তোমার নাম কী, ভাই?
মোতালেব।
কোথায় থাকো?
নারিন্দায়।
এখানে রোজ বসো?
বসি।
ঠিক আছে, তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।
লোকটি আকমল হোসেনের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে গাড়ি পর্যন্ত আসে। আকমল হোসেন গাড়িতে উঠে বসলে মোতালেব ফিসফিস করে বলে, স্যার, আগামী সপ্তাহ থেকে আপনি আর আমাকে এখানে পাবেন না। আমি দেশে চলে যাব। ওখান থেকে যুদ্ধ করতে যাব। ওরা আপনাকে গাদ্দার বলেছে—আমার গায়ে আগুন ধরে গেছে। কারণ, আপনি গাদ্দার হলে আমিও গাদ্দার। আপনি আমাকে দোয়া করবেন।
আকমল হোসেন ওর মাথায় হাত রাখেন। বলেন, বিজয়ীর বেশে ফিরবে দেশে—এই দোয়া করি।
দেশ স্বাধীন হলে আপনি আমাকে এখানে খুঁজতে আসবেন তো, স্যার?
আসব। অবশ্যই আসব। তোমার জন্য আমি ফুল নিয়ে আসব। বিজয়ীকে ফুলের মালা দেব।