আয়শা খাতুন চুপচাপ বসে থাকেন। আকমল হোসেনের কথায় মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানান। মেরিনা চলে গেছে নিজের ঘরে। বিছানায় শুয়ে কপালে হাত দিয়ে রাখে। আকমল হোসেন পেছনের বারান্দায় গিয়ে বসে থাকেন। বুক ভীষণ ভার হয়ে আছে। এই প্রথম একটি ঘটনা তাঁকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে ফেলে। ভাবেন, কত দিন লাগবে এই সামলে উঠতে!
তখন গুনগুন ধ্বনি ছড়াতে থাকে ঘরে। আয়শা খাতুন সোফায় মাথা হেলিয়ে দিয়েছেন। ঘরে বাতি নেই। অন্ধকার গুমরে ওঠে সুরের ছায়ায় :
কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না
শুকনো ধুলো যত।
কে জানিত আসবে তুমি গো
অনাহূতের মতো॥…
মেরিনা শূন্য দৃষ্টিতে ঘরের ছাদ দেখে। ইলেকট্রিক বাতির চারপাশে পোকা জমেছে। কোথা থেকে এল এরা? দুচোখ ববাজে মেরিনা। ভালো লাগে না। আবার উঠে দাঁড়ায়। ভাবে, বাতি বন্ধ করলে পোকাগুলো বেরিয়ে যাবে। পরক্ষণে সিদ্ধান্ত পাল্টায় ও। বাতি বন্ধ করলে পোকাগুলো সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়বে। তার চেয়ে ওগুলো যেখানে আছে সেখানেই থাকুক। মেরিনা টেবিলের ড্রয়ারে যত্ন করে রাখা জেবুন্নেসার চিঠিটা আবার বের করে। টেবিলের ওপর মেলে রেখে পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেয়। তাকিয়ে থাকে পেনসিলে লেখা অক্ষরগুলোর দিকে। এটা জেবুন্নেসার হাতের লেখা নয়। পরদেশী বলেছে, জেবুন্নেসা বলেছে আর একজন মেয়ে লিখে দিয়েছে। হঠাৎ মেরিনার মনে হয়, পেনসিলের লেখা যদি ঝাপসা হয়ে যায়, তাহলে মারুফ কীভাবে পড়বে? তখন ও কাগজ-কলম বের করে কালো কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে পুরো লেখাটা লিখে ফেলে। ভাবে, মারুফ ইচ্ছা করলে এই চিঠিটা অনেক দিন সংগ্রহে রাখতে পারবে। হায় ভাইয়া, তোমার প্রথম প্রেম। দেশ স্বাধীন হলে যদি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জাদুঘর হয়, তখন জেবুন্নেসার ছবি আর এই চিঠিটা সেখানে রাখা যাবে। দেশের ইতিহাসে যুক্ত হবে জেবুন্নেসার নাম। মেরিনা চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারে না। দুহাতে চোখের পানি মোছে আর ফোঁপায়।
আয়শা খাতুন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। অন্ধকারে পা ফেলেন। জানালার পর্দার ফাঁকে রাস্তার বাতির আলো আসছে। তিনি ক্ষুদ্র একটি আলোর বৃত্তের পাশে দাঁড়ান—সুরের ধারা আলোকিত করে ঘর :
পার হয়ে এসেছ মরু, নাই যে সেথায় ছায়াতরু–
পথের দুঃখ দিলেম তোমায় গো এমন ভাগ্যহত॥
আলসেতে বসে ছিলেম আমি আপন ঘরের ছায়ে,
জানি নাই যে তোমায় কত ব্যথা বাজবে পায়ে পায়ে।
ওই বেদনা আমার বুকে বেজেছিল গোপন দুখে—
দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো গভীর হৃদয়ক্ষত।।
আকমল হোসেন কান খাড়া করে গুনগুন ধ্বনি শুনছেন। একসময় দুহাতে নিজের চুলের মুঠি ধরে বুক ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। এমন বুক উজাড় করা কান্না আরও একবার কেঁদেছিলেন মায়ের মৃত্যুতে। বাবার মৃত্যুতেও এমন করে কাঁদেননি। ছেলেটির প্রথম প্রেম ভেবে এমন কান্না তাঁকে ভাসিয়ে দেয়।
তখন আয়শা খাতুন নিজের ঘরে আসেন—সুর থামে নাস্তিমিত হয়–হাহাকারের ধ্বনি তোলে ঘরের ভেতর—দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো গভীর হৃদয়ক্ষত॥–দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো—আয়শা খাতুন কাঁদতে থাকেন। বুঝতে পারেন, এই মুহূর্তে কান্না ছাড়া তিনি আর কিছুই করতে পারছেন না।
তাঁর কান্নার ধ্বনি ছড়ালে দরজায় এসে দাঁড়ান আকমল হোসেন। তাঁর পেছনে মেরিনা।
০৪. বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে
শুক্রবার।
আকমল হোসেন বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এখনো জুমার নামাজ শুরু হয়নি। মুসল্লিরা ঢুকছেন। মাথায় টুপি দেওয়া লোকজনে ভরে আছে প্রাঙ্গণ। যারা আশপাশে আছে, তাদের মাথায়ও টুপি। আকমল হোসেন নিজেও মাথায় টুপি দিয়েছেন। মিনিট দশেক আগে এসেছেন। তিনি জানেন, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না। তাহলে আশপাশের লোকজন মনে করবে তিনি কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। তাই তিনি ঠিক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে এদিক-ওদিক যাচ্ছেন। কোনো দোকানে ঢুকছেন কিংবা ফুটপাতের দোকানদারদের সঙ্গে কোনো কিছু দরদাম করছেন। টুকটাক কিছু কিনছেনও। মাঝেমধ্যে চারদিকে তাকান। দেখতে পান, তাঁর গাড়ির কাছে আলতাফ দাঁড়িয়ে ডাব খাচ্ছে। তিনি টুপিটা খুলে পকেটে ঢোকান। ভাবেন, টুপি মাথায় দিয়ে ঘোরাঘুরি করা ঠিক নয়। লোকে অন্য রকম ভাবতে পারে।
গত রাতে মেরিনার কাছে চিরকুট এসেছে মারুফের। ও লিখেছে : দুটি অপারেশনের দায়িত্ব নিয়ে আবার শহরে ঢুকব। বাসায় যাব কি না ঠিক নেই। বেশি যাতায়াত করলে বাড়ি চিহ্নিত হয়ে যাবে। তাই এমন কৌশল। বাবা যেন শুক্রবার জুমার নামাজের আগে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে থাকেন। ওখানে বাবার সঙ্গে দেখা হবে এবং একই সঙ্গে গুলিস্তান এলাকা রেকি করা হবে। তুই কেমন আছিস, মেরিনা? এখন আমাদের জীবনে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান, মনে রাখিস।
কিন্তু আধা ঘণ্টা হয়ে গেলেও মারুফের দেখা মিলছে না। কোথায় গেল ছেলেটি? আটকালই বা কোথায়? নাকি এখানে আসার সময় বদলেছে? আকমল হোসেন চিন্তায় পড়েন। দুদিন পর ওরা পরপর দুটি অপারেশন করবে। গুলিস্তানের গ্যানিজ ও ভোগ—অবাঙালিদের দোকান। গেরিলারা এ দোকানে অপারেশন চালাবে। এতক্ষণ অপেক্ষা করে আকমল হোসেনের অস্থির লাগছে। তিনি নিজেই গ্যানিজ দোকানটির চারপাশ রেকি করবেন ঠিক করেন। তার নজরে কিছু পড়লে তিনি তা মারুফকে জানাতে পারেন। সিদ্ধান্ত নিয়ে আকমল হোসেন রাস্তা পার হয়ে দোকানের সামনে আসেন। তারপর ভেতরে ঢোকেন। বড় দোকান। ঘরভর্তি মালপত্র। বেশির ভাগ দ্রব্যই পোশাকসামগ্রী। তিনি অনেকবার এ দোকানে এসেছেন। প্রয়োজনীয় কাপড় কিনেছেন। আজ দোকানের ভেতরে ঢুকে চারদিক খেয়াল করেন। নিরাপত্তাকর্মীদের অবস্থান লক্ষ করেন। একসময় ফিরে আসেন বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে। মারুফের পাত্তা নেই। কী হলো ছেলেটির? নিশ্চয় পরিকল্পনায় কোনো রদবদল হয়েছে। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। ভাবছেন, ফিরে যাবেন। আবার ভাবলেন, আর কিছুক্ষণ থাকবেন। ছেলেটা কোথাও হয়তো আটকে গিয়েছে। কাজ শেষ হলে ছুটতে ছুটতে আসতেও পারে। সেই চিন্তায় ফলের দোকানে দাঁড়ালেন। আয়শা খাতুন। পেয়ারা ভালোবাসেন। মেরিনা আমড়া-কামরাঙা খোঁজে। তিনি নিজে জাম্বুরা খেতে ভালোবাসেন। তিনজনের তিন ধরনের ফল পছন্দ। এ জন্য বাড়িতে সব রকম ফলই থাকে। এত কিছুর পরও কমলা-আপেল কিনলেন। ভাবলেন, যোদ্ধা ছেলেদের যদি কেউ আসে তাদের জন্য এসব ফল দরকার হতে পারে। আলতাফকে ডেকে সেগুলো গাড়িতে পাঠালেন।