পরদেশী আবার গেটে শব্দ করে। এবার বেশ জোরে। বোঝাতে চায় যে ও এই বাড়িতেই এসেছে। ও ঠিকানা ভুল করেনি বলেই নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে। পরদেশীকে গেটের কাছে এসে দাঁড়াতে দেখে আলতাফ দুপা এগিয়ে বলে, কাকে চান?
এ বাড়ির কাউকে। এটা তো জনাব আকমল হোসেনের বাড়ি?
হ্যাঁ, তার বাড়ি। কোথা থেকে এসেছেন?
রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে।
ফিসফিস করে বলে পরদেশী। চারদিকে তাকায়। আলতাফ বুঝে যায় যে ও কোনো খবর নিয়ে এসেছে।
পরদেশী অস্থির হয়ে ওঠে। যেন ধৈর্য ধরার সময় নয় এখন। যা কিছু করার তা করতে হবে বিদ্যুৎ-গতিতে। বুকের ভেতর উত্তেজনা থরথর করে কাঁপে পরদেশীর।
কে আছেন বাড়িতে? তাঁকে ডাকেন।
আপনি ভেতরে আসেন। বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হবে না।
আলতাফ গেট খুলে দেয়। ও বুঝতে পারে যে লোকটি হয়তো গেরিলাদের খবর নিয়ে এসেছে। ওকে দেখে আকমল হোসেন এগিয়ে আসেন। পরদেশী কাঁপা গলায় তাকে বলে, আমি একটা চিঠি নিয়ে এসেছি।
চিঠি? কার চিঠি?
একজন শহীদের।
শহীদ? মারুফের বন্ধু নাকি?
শুনেছি বন্ধু। মারুফ কই?
ও তো যুদ্ধে গেছে। গেরিলা হয়েছে।
যখন বাড়িতে আসবে, তাকে এই চিঠিটা দেবেন।
ও চারদিকে তাকিয়ে জামার বোম খুলে চিঠি বের করে আকমল হোসেনের হাতে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমি জল খাব। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
আকমল হোসেন চিঠিটা নিয়ে বলেন, আলতাফ, পানি। তুমি আমার সঙ্গে এসো। বসো।
আলতাফ পানি আনতে যায়। রান্নাঘরে গিয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে গেলে গ্লাস উপচে পানি পড়ে মেঝেতে। মন্টুর মা রাগতস্বরে বলে, কী হয়েছে? হাত কাঁপে কেন?
আলতাফ উত্তর দেয় না।
আকমল হোসেন পরদেশীর হাত ধরেন। বারান্দায় যে চেয়ার ছিল, সেটা টেনে বসতে দেন। বুঝতে পারেন, ওর ভেতরে একধরনের অস্থিরতা কিংবা প্রবল আবেগ কাজ করছে। ও খুব স্বাভাবিক নয়। তিনি খুব শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করেন, কোথা থেকে এসেছ?
রাজারবাগ পুলিশ লাইন। ওখানে সুইপারের কাজ করি।
বুঝেছি। আকমল হোসেন মাথা নাড়েন। হেঁটে এসেছ বোধ হয়, তোমাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে।
হ্যাঁ, হেঁটেই এসেছি। তবে টায়ার্ড না। আমি অনেক কাজ করতে পারি। আমি যুদ্ধ করতেও পারব।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আয়শা খাতুন আর মেরিনা। আকমল হোসেন চিঠিটা আয়শা খাতুনের হাতে দিয়ে বলেন, ও এই চিঠিটা এনেছে। তুমি আগে পড়ে দেখো।
পরদেশী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি পরদেশী। সুইপার।
তুমি এখানে বসো। মেরিনা, ওকে হালুয়া আর চা দে।
না, মাইজি, হালুয়া খাব না। শুধু জল।
তা হবে না। যুদ্ধের সময় এখন। সব যোদ্ধাকে একটু কিছু খেতে হবে এই বাড়িতে। এটা হলো যোদ্ধাদের জন্য দুর্গবাড়ি।
ও ঘন ঘন মাথা নাড়িয়ে বলে, বহুত আচ্ছা, মাইজি, বহুত আচ্ছা। আমি চেয়ারে বসব না। এখানে বসি।
পরদেশী সিঁড়ির ওপর পা গুটিয়ে বসে। সুজির হালুয়া খায়। প্রাণভরে কয়েক গ্লাস জল খায়। বুঝতে পারে না এই বাড়িতে বসে আজ ওর এত তেষ্টা পাচ্ছে কেন? কোথাও কিছু কি ভেঙেচুরে পড়ে যাচ্ছে? পরদেশী যাওয়ার জন্য দাঁড়ালে আকমল হোসেন বলেন, পুলিশ লাইন তো আমাদের আরেকটা যুদ্ধক্ষেত্র, না?
হ্যাঁ, স্যার। ওখানে এই শহরের অনেক মেয়ে যুদ্ধ করছে।
বুঝেছি। আমার ছেলে এলে বলব তোমাকে মেলাঘরে নিয়ে যেতে। তোমার বাড়ির ঠিকানা আমাকে দিয়ে রেখো।
না, স্যার, আমি অন্য কোথাও যাব না। আমি আমাদের মেয়েদের বাঁচাতেই যুদ্ধ করব। আমি যাই, স্যার। আকমল হোসেন পরদেশীর সঙ্গে হেঁটে গেটের কাছে যান। ও বেরিয়ে গেলে গেট বন্ধ করে আলতাফ। তিনি আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। দিনের আলো শেষ হয়েছে। আকাশের লাল রং আর নেই। ওখানে ছাই রঙের ফ্যাকাশে বিবর্ণ ভাব ছড়িয়ে আছে। অন্ধকার পুরো নামেনি। অল্পক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামবে। তিনি দাঁড়িয়েই থাকেন। ভাবেন, পরদেশী তার চোখ খুলে দিয়েছে। যুদ্ধের সময় যে অনেক রকম যুদ্ধক্ষেত্র হয়, সেই কথা বলে গেছে ও। এর চেয়ে বড় সত্য আর কী হতে পারে? তিনি নড়তে পারেন না। পঁড়িয়েই থাকেন। মনে হয়, তার কী যেন হয়েছে। তিনি তা বুঝতে পারছেন না। পেছন ফিরে দেখেন, আয়শা খাতুন আর মেরিনা ঘরে চলে গেছে। একসময় মেরিনা চিৎকার করে ডাকে, আব্বা-আ-ব-বা—।
তিনি ধীরপায়ে ঘরে ঢোকেন। সোফায় বসেন। দেখতে পান, মা-মেয়ে কাঁদছে। কান্না থামিয়ে একসময় আয়শা খাতুন বলেন, এটি জেবুন্নেসা নামের একটি মেয়ের চিঠি। মারুফের সঙ্গে ওর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। পঁচিশের রাতে আর্মি ওকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে নিয়ে আটক করে।
মেরিনা চোখ মুছে বলে, ভাইয়া আমাকেও জেবুন্নেসার কথা বলেনি। সম্পর্ক বোধ হয় বেশি দিনের না। তাহলে আমি জানতে পারতাম। আমি ইউনিভার্সিটিতে জেবুন্নেসাকে দেখেছি। ফিজিকস পড়ত। কার্জন হলের বারান্দায় হেঁটে যেতে দেখেছি। তবে তেমন পরিচয় ছিল না।
চিঠিটা তুমিই যত্ন করে রেখে দাও, মা। আমাদের কাছে থাকা ঠিক হবে না।
আকমল হোসেন সোফা থেকে উঠে দাঁড়ান। মেরিনাও উঠে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ভাইয়া বাড়িতে এলে দেব? নাকি অনেক পরে দেব?
না, ও বাড়িতে এলেই দিয়ো। ওকে একা দিয়ো আগে। আমাদের সামনে দিয়ো না। ও যদি আমাদের কিছু বলে তা আমরা শুনব।
তিনি কয়েক পা এগিয়ে আবার ফিরে আসেন। আয়শা খাতুনের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, মেয়েটি আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম শহীদ। কয়েকজনকে ডেকে ঘরোয়া মিলাদের আয়োজন করো। আর ফকির খাওয়াও। ওর কুলখানি হবে এই বাড়িতে।