সেই রাতে মৃত্যু হয় জেবুন্নেসার। ডডামেরা এসে সরিয়ে নিয়ে যায় জেবুন্নেসার লাশ। কোথায় নিয়ে যাবে, তা জানতে পারে না রাবেয়া। ও শুধু অনুভব করে ব্লাউজের ভেতর রাখা আছে জেবুন্নেসার চিঠি আর বাড়ির। ঠিকানা। শীতল হয়ে থাকে রাবেয়া। মুখে কথা নেই। নীলু ওকে ডাকে, খালা। আপনার কী হয়েছে?
রাবেয়া ওর দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে।
নীলু রাগতস্বরে বলে, নিঃশ্বাস ফেললা না, খালা। নিঃশ্বাসের শব্দ পেলে আমার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। তুমি যদি আমাকে একটা ছুরি না দাও, তাহলে তোমাকে আমি গলা টিপে মেরে ফেলব।
চুপ কর, নীলু। গলা নামিয়ে কথা বল।
আমার গলা আর নামবে না। তোমাকে বলে রাখলাম, একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব।
করিস। আমি নিচে যাচ্ছি।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় রাবেয়া শুনতে পায় নীলু চিৎকার করে কাঁদছে। ওর মনে হয়, ও নামছে তো নামছেই। সিঁড়ি আর শেষ হয় না। কতকাল লাগবে এই সিঁড়ি শেষ হতে? পরক্ষণে নিজে সিঁড়ির ওপর বসে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ওর ক্রন্দনধ্বনি পৌঁছে যায় পুলিশ লাইনের সুইপারদের কাছে।
পরদিন দুপুর।
হালকা মেঘের আড়ালে রোদ ঝিমিয়ে পড়েছে পুলিশ লাইনের প্রাঙ্গণে। শত শত মৌমাছি কোথা থেকে উড়ে আসছে কেউ বলতে পারে না। তাদের গুঞ্জনে মুখরিত প্রাঙ্গণ। প্রত্যেকে মুখ তুলে চারদিকে তাকায়। ভাবে, আজ এত মৌমাছি কেন? কোথা থেকে এল? পুলিশ লাইনের ব্যারাক-অফিস-প্রাঙ্গণ তো সরষেখেত নয় যে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করতে এসেছে? প্রতিটি ব্যক্তির কপাল কুঁচকে থাকে। তারা ফিসফিস করে বলে, হলো কী আজ? বেলুচিস্তানের সৈনিক বুখারি পাঞ্জাবি সেনা গিলানিকে বলে, কেয়া হুয়া ভাইয়া? বুখারি দেখতে পায়, ওর রাইফেলের বাটে মৌমাছি এসে বসেছে। ভরে গেছে পুরো রাইফেল। দোতলার ঘরে যন্ত্রণায় তড়পাতে তড়পাতে নীলু ভাবে, জেবু আপার চিঠিটা নিতে এসেছে মৌমাছির ঝাঁক। একজন শহীদ নারীর কথা ওরাও ছড়াবে তো! ও ব্যারাকের সব জায়গায় দৌড়ে দৌড়ে বলে, আমরা শহীদ নারী হব। আমাদের কথা পৌঁছে যাবে দেশের মানুষের কাছে। আজ আমাদের এখানে কোনো সেনা নেই। আজ এই ব্যারাক আমাদের আর শত শত মৌমাছির। দেখো, বারান্দায় ঘরের দেয়ালে ফুলের মতো বসে আছে ওরা। ওরা জেবু আপার চিঠি বয়ে নিয়ে যাবে, হ্যাঁ, এ জন্যই এসেছে।
পরদেশী যাদবকে বলে, মৌমাছিরা আমাদের বন্ধু। ওরা কোন ফুলের ঘ্রাণে এখানে এসেছে রে?
গতকাল যে ফুল ফুটেছে তার ঘ্রাণে এসেছে ওরা।
ঠিক বলেছিস, একজন শহীদ নারী স্বাধীনতার সৌরভ।
এই সৌরভ পেয়েই উড়ে এসেছে মৌমাছি। আমার ইচ্ছা হচ্ছে কিছু মৌমাছি ধরে বাড়ি নিয়ে যাই। আজ ওরা আমাদের হুল ফোঁটাবে না।
না থাক, ওদেরকে ওদের মতো করেই থাকতে দে। বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
তখন ড্রেনের পাশে এসে দাঁড়ায় রাবেয়া। পরদেশীকে বলে, এই শহীদ মেয়েদের জন্য তোর কাছে কাজ এসেছে পরদেশী। কাজটা আজই করতে হবে। এক দিনও দেরি নয়।
কাজ? কী করব ওদের জন্য? দুহাতে নিজের বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলে, ওদের জন্য কাজ করে ধন্য হতে চাই আমি।
এই চিঠিটা পৌঁছাতে হবে হাটখোলার একটি বাড়িতে। এই যে ঠিকানা।
দে, দে। আমি আমার বুকপকেটে রাখব?
হ্যাঁ, বুকপকেটেই রাখ।
সিকিউরিটির লোকেরা যদি আমার শরীর হাতড়ায়? যদি চিঠিটা কেড়ে নেয়?
তাহলে পকেটে রাখিস না। জামার ভেতরে রাখ। চিঠিটা যেন তোর বুকের সঙ্গে মিশে থাকে।
পরদেশী খুব যত্ন করে চিঠিটা বুকের সঙ্গে লাগিয়ে নেয়। তারপর শার্টের সব বোম লাগায়।
আমার মুক্তিসেনা বোনটা আমাকে একটা কাজ দিয়েছে। আমার সারা জীবন মনে থাকবে। আমি গেলাম। আয় যাদব। তুইও আমার সঙ্গে যাবি।
রাবেয়া বাধা দেয়। দুহাত বাড়িয়ে বলে, না, দুজন একসঙ্গে যাবে না। বিপদ হলে একজনেরই হবে। যাদবকে থাকতে হবে আর একজন শহীদ মেয়ের জন্য।
হ্যাঁ, ঠিক। আমি একাই যাই।
পরদেশী চলে যায়। যাদবও অন্যদিকে যায়। রাবেয়া একা দাঁড়িয়ে থাকে। দুহাতে চোখের জল মোছে।
পরদেশী যখন হাটখোলার বাড়িতে আসে চিঠির ঠিকানা ধরে, তখন শেষ বিকেল। পশ্চিম আকাশটা অদ্ভুত লাল রং ধরে আছে। অথচ এক স্লান আলোয় ভরে আছে শহর। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার রাস্তায় চোখ রেখে, পরদেশীর এমনই মনে হয়। মনে হয়, শহর খুব বিষণ্ণ হয়ে আছে। ও বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে টুকটুক শব্দ করে। গেটের কাছে আলতাফ ছিল। কাছে এগিয়ে আসে। গেটের অল্প ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা যে কে এসেছে, কিন্তু পরদেশীর পুরো শরীর দেখা যায় না। মুখ তো নয়ই। কারণ ও ঘাড়টা রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। লোকজনের চলাচল খেয়াল করছে। বাড়ির ভেতরে আকমল হোসেন সামনের ছোট পরিসরে পায়চারি করছিলেন। কখনো আকাশ দেখেন, কখনো কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকেন-কী শুনতে চান তিনি নিজেও তা বুঝতে পারেন না। বোমার শব্দ, আর্মি কনভয়ের চলাচল, আয়শার গুনগুন ধ্বনি, কিংবা উচ্চস্বরে কান্নার শব্দ—বুঝতে পারেন সবকিছু একসঙ্গে চলছে বলে তিনি কোনো কিছু আলাদা করার কথা ভাবেন না। কিন্তু তার পরও তার মনে হয়, কারও পায়ের শব্দ এ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কেউ কোনো বার্তা নিয়ে এসেছে কি? মারুফ কেমন আছে? ও এখন কোথায়, তা তার জানা নেই। তিনি নিজের সঙ্গে নিজের চিন্তা যোগ করতে পারেন না। মনে হয়, চিন্তার পরিসর বেড়ে যাচ্ছে, তারও বড় জমিন। তৈরি হয়েছে তার জন্য। এখন তার অপেক্ষার সময়। তিনি আকাশের দিকে তাকান—অদ্ভুত রংটা আরও বেশ অনেকখানি ব্যাপ্তি নিয়ে ছড়িয়েছে।