এমন কথা জিজ্ঞেস কোরো না। আমার কাগজ-পেনসিল এনেছ?
হ্যাঁ, এনেছি। এখন দেব না। তুমি তো লিখতে পারবে না।
এভাবে পারব না। পাশের ঘরে নীলু আছে। ওকে ডাকো। ও লিখবে। তোমাকে ভাত খাইয়ে দিই?
না। আমি আর কথা বলতে পারব না, খালা।
রাবেয়া বুঝতে পারে, কথা বলতে মেয়েটির কষ্ট হচ্ছে। ও হয়তো আর বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবে না। ওর সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফুরিয়ে যাওয়া সময়ের আগে ওকে ওর নিজের মতো থাকতে দিতে হবে। শৈশব থেকে গড়ে ওঠা এক আশ্চর্য পৃথিবী এখন ওর সামনে। সেই পৃথিবীর দেখা-না-দেখার আকাঙ্ক্ষায় ওর বুকের জমিন তোলপাড়। ও আর কথা বলবেই বা কেন? ও দেখুক নিজের জীবনের কাটিয়ে আসা সময়টুকু। ফাঁকফোকর-গলিঘুপচি সবটুকু হাতড়ে দেখুক-পায়ে হেঁটে দেখুক-একছুট দিয়েও দেখে আসতে পারে। এটা মানতে হবে যে যুদ্ধের সময় অনেক অনেক মেয়ে কেবলই ক্ষতবিক্ষত হয়। রক্তাক্ত হয়। তারপর টুপটাপ রক্ত ঝরে। ঝরতেই থাকে। মেঝেতে রক্ত ছড়ায়। আর মেয়েরা শ্বাস নিতে ভুলে গিয়ে ঝুলে থাকা দৃষ্টি দিয়ে রক্তমাখা মেঝে দেখে। জেবুন্নেসা ধরে নেয়, এভাবে দেখতে শেখা যুদ্ধের সময়ের নিয়ম। মেঠো মাটি নয় যে রক্ত শুষবে। পিচ্ছিল মেঝেতে রক্ত কালো দাগ হয়ে দু-চার শ নদীর মতো শুকিয়ে থাকা। গড়িয়ে যাওয়া রক্তের আঁকাবাঁকা রেখা জেবুন্নেসার দৃষ্টিতে এক মানচিত্র, যেখানে জনপদ আছে, মানুষের বসবাস আছে। এসব জায়গা এখন দুর্গ, মিলিটারি কনভয় এবং যুদ্ধের তাণ্ডব। রক্ত, মৃত্যু, জীবন এক সুতায় সমান্তরাল গাঁথা। এই মানচিত্রে শত শত মাইল শস্যক্ষেত্র আছে, পতিত জমি ও সীমান্তরেখা মানচিত্রের পৃষ্ঠার রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্র। সারা দেশের শহরগুলো গেরিলাযুদ্ধে আক্রান্ত। লড়ছে শহরবাসী—নানা কৌশলে, নানা সূত্রে-পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ রেখে অথবা না রেখে। সত্য শুধু লড়াই। জেবুন্নেসা তাকিয়ে থাকলে নিজের পরিবারের হারিয়ে যাওয়া ছবি দেখতে পায়। ভাবে, ওরা কোথাও না কোথাও আছে গ্রামে অথবা শহরে, নানা অথবা দাদার বাড়িতে। নয়তো চাচা-মামা কারও সঙ্গে ওর মা সব ভাইবোনকে নিয়ে চলে গেছে। হয়তো ওদের সঙ্গে মারুফের দেখা হতে পারে। মারুফকে ওর মা চেনে না, মারুফও ওর মাকে দেখেনি। তার পরও দেখা গেল, কাকতালীয়ভাবে পরিচয় হয় মারুফের সঙ্গে। পথের ধারে একজন নারীকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসে থাকতে দেখে মারুফ এগিয়ে যায়। বলে, মাগো, আমার সঙ্গে আসুন। আমি আপনাকে শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছে দেব। কোনো ভয় করবেন না। আমি আপনার দেখাশোনা করব। তখন মা বলবেন, আমার জেবুন্নেসাকে আর্মি তুলে নিয়ে গেছে। ওকে আমি কোথায় খুঁজব, বাবা?
জেবুন্নেসা! মারুফের ভুরু কুঁচকে যাবে। তারপর বলবে, ঠিক আছে, আপনার জেবুন্নেসাকে আমি খুঁজে দেখব। শরণার্থী শিবিরের সব মেয়ের নাম আমি জিজ্ঞেস করব। ওকে খুঁজে পেলে আপনার কাছে নিয়ে আসব।
ওকে তো আর্মি নিয়ে গেছে, বাবা।
মাগো, আমি সাধ্যমতো খুঁজব।
ভালোবাসার মানুষটিকে মনে করে জেবুন্নেসা চোখ বুজে বড় করে শ্বাস টানে। ভাবে, যুদ্ধের সময় প্রিয়জনকে তো এভাবেই মনে করতে হয়। যুদ্ধের পরিস্থিতির বাইরে তো কাউকে স্মরণ করা যায় না। যুদ্ধের সবটুকু সেই স্মরণে থাকে।
একসঙ্গে শহরের আনন্দে ফুটে ওঠে দৌড়ে যাওয়া গেরিলাদের সন্তর্পণ বিচরণক্ষেত্র। যেখানে অস্ত্র এবং সাহস এক সুতায় গাঁথা হয়। যেখানে জীবনের পক্ষে নানা উপচার সজ্জিত গৃহগুলো সাহসীদের হাত ধরে বলে, আবার এসো, আমরা তোমাদের অপেক্ষায় আছি।
আর গোলাবারুদ-ট্যাংক-মর্টার-মেশিনগান আশ্চর্য দ্যুতিময় ঝলকানিতে স্বাধীনতার জন্য লড়াকু মানুষের চকচকে দৃষ্টি হয়ে বলে, ডর নেই। আমরা জয়ী হবই। যত রক্ত এবং জীবন দিতে হোক না কেন, দেবই। স্বাধীনতার সোনালি শস্যক্ষেত্রে দেখো অলৌকিক ফুল ফুটেছে। যে ফুলের নাম জীবন।
জেবুন্নেসার চোখ বুজে আসে।
জেবুন্নেসা মুখ দিয়ে শ্বাস টানে।
জেবুন্নেসার শরীর রক্তে ভাসিয়ে দিচ্ছে মেঝে। ওর জীবনপ্রদীপের শিখায় প্রবল বাতাসের ধাক্কা—ওটা নিবুনিবু প্রায়।
তখন নীলুকে নিয়ে ফিরে আসে রাবেয়া। নীলু স্কুলের ছাত্রী। ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। ওর কৈশোরের চোখজোড়া আশ্চর্য শাণিত। বলছে, জেবু আপা, আমি আপনার কী কাজে লাগব?
তুমি আমার জন্য একটি চিঠি লিখবে।
চিঠি? এত সামান্য কাজ দিচ্ছেন?
সামান্য নয়, নীলু। এটি অনেক বড় কাজ। আমি এক সত্য কথা বলতে চাইব এখন।
আপনি বলুন, আমি লিখছি।
জেবুন্নেসা অস্ফুট ধ্বনিতে বলে, প্রিয় মারুফ, আমি তোমার ভালোবাসায় একটি সুখী মেয়ে ছিলাম। তোমার ভালোবাসা স্বাধীনতার জন্য আমার প্রিয় দেশ এখন। আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। ওরা আমার লাশ শিয়ালশকুনকে খেতে দিলেও আমি বলব, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত। যুদ্ধের বসন্ত। তুমি সবাইকে বলবে, যুদ্ধের বসন্তে জেবুন্নেসা শহীদ নারী। ও স্বাধীনতার জন্য নিজের সবটুকু দিয়েছে। এই নিবেদনে ওর ত্যাগ ছিল, কিন্তু ভয় ছিল না।
জেবুন্নেসার কথা ফুরিয়ে যায়। ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মেধাবী ছাত্রী। ও অস্ফুট ধ্বনিতে বলে, এই চিঠি মারুফের কাছে পৌঁছে দিয়ো, খালা। ওকে পেলে ওর বোনকে দিয়ে। ওকেও না পেলে ওর মাকে দিয়ে। নইলে ওর বাবাকে। কেউ না কেউ যেন জানতে পারে জেবুন্নেসা যুদ্ধের আর একটি ক্ষেত্রে শহীদ হয়েছে। ওকে জয়ের তিলক পরানো হবে, কলঙ্কের নয়।