রাবেয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, তুমি ঘুমাও, মেয়ে।
এত কথা বললে তোমার শক্তি কমে যাবে। তোমাকে আমি ছুরি দেব। তোমার সামনে যুদ্ধ আছে।
হ্যাঁ, আমি যুদ্ধ করব। তার পরও তোমাকে মারুফের কথা বলতে আমার ভালো লাগছে। মারুফের বাড়িতে কেউ আমাকে চেনে না। ওর বোন মেরিনাকে আমি দূর থেকে দেখেছি। মারুফকে না পেলে আমার চিঠিটা মেরিনার কাছে দিয়ে। মেরিনাকে যতটুকু দেখেছি, ভালো মেয়ে মনে হয়েছে। ও আমার ওপর রাগ করবে না।
তুমি আর কথা বোলো না, জেবুন্নেসা।
আমার তো কথা বলতে ভালো লাগছে। আমি তো ভাবতে পারছি যে আমি মারুফের সঙ্গে কথা বলছি। অসহযোগ আন্দোলনের পুরো সময় আমরা অনেক কথা বলেছি। আমরা দুজনেই যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়েছিলাম। আমরা ট্রেনিং নিয়েছিলাম। মিছিল করেছিলাম। যেদিন আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল, সেদিন ও বলেছিল, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত। আমি হেসে বলেছিলাম, ইয়াহিয়া খান দেশে অস্ত্র আর সৈন্য এনে ভরে ফেলেছে, তুমি বসন্তের কথা বলছ? ও বলেছিল, অস্ত্রের ফাঁক গলিয়ে যে ফুলটি ফুটবে, সেই ফুলটি আমি তোমাকে দেব, জেবু। বলব, তোমার খোঁপায় স্বাধীনতা খুঁজে দিলাম। ওর সঙ্গে কথা বলে খুব আনন্দ পেতাম, খালা। আমার যুদ্ধের কথা তুমি ওকে বোলো, খালা।
বলব, বলব। আমি সব বলব ওকে। তুমি থামো।
সেদিন জেবুন্নেসা আর কথা বলেনি। ওর চোখ বুজে এসেছিল। ও নেতিয়ে পড়েছিল। জ্ঞান হারিয়েছিল। আমি ওর চোখমুখে পানি ছিটিয়ে বলেছিলাম, জেবু, ওঠো। জেবুন্নেসা ওঠেনি। আমি ডাক্তারকে খবর দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, স্যার, মেয়েটাকে দেখেন। ও বোধ হয় বাঁচবে না।
ডাক্তার বিরক্তির সঙ্গে আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, এদের মরাই উচিত। এগুলো বাঁচবে কোন সাধে? ভাগাড়ের শকুন সব।
ডাক্তার জেবুন্নেসাকে দেখতে আসেনি। পুলিশ লাইনের বাঙালি ডাক্তার। সেদিন রাবেয়া মনের সুখে গাল দিয়েছিল, জাউরা একটা। হারামি। যুদ্ধ বোঝে না। স্বাধীনতা বোঝে না। হারামি নিজের জীবন বোঝে শুধু। হারামি, তুইও বাঁচবি কোন সাধে?
তারপর একদিন ভরদুপুরে, যখন হালকা মেঘের আড়ালে রোদ ঝিমিয়ে পড়েছে পুলিশ লাইনের ওপর, কোনো জরুরি অপারেশনে বেরিয়েছিল বেশির ভাগ মিলিটারি গাড়ি, সেদিন এক শ টা কমলা নিয়ে এসেছিল ডাক্তার আহমদ। বলেছিল, ওদের দেখার মতো মনের জোর আমার নাই, রাবেয়া। ওদের জন্য ওষুধ বরাদ্দ নাই। চিকিৎসাব্যবস্থার কিছু নাই। ওদের জন্য আমি কিছু করতে পারব না বলে আমি আসি না। তুমি আমার কথায় কিছু মনে করবে না।
স্যার, আপনি কী যে বলেন।
রাবেয়া বিব্রত এবং লজ্জিত হয়েছিল।
এই কমলাগুলো রাখো। লুকিয়ে রাখবে। ওদের খেতে দিয়ো। আর বলবে, লাইনের ডাক্তার ওদের জন্য কিছু করতে পারেনি বলে তার মরে যেতে ইচ্ছা করে।
যুদ্ধে যেতে ইচ্ছা করে না, স্যার?
হ্যাঁ, করে। কিন্তু বিছানায় পড়ে যাওয়া বাবাকে ফেলে আমার যুদ্ধে যেতে ভয় করে। মানুষটা আমার দুহাত জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদে। বলে, আমাকে বিষ দে, খোকা। আমি মরে যাই। তুই যুদ্ধে যা। আমি এসব কথা শুনলে বোকা হয়ে যাই। আমার চারদিকে অন্ধকার।
সেদিন ডাক্তার আহমদকে একজন অসহায় মানুষ মনে হয়েছিল রাবেয়ার। মনে হয়েছিল, ওর নিজের যে মনের জোর আছে, সেটুকু এই ডাক্তারের নেই। ও হাত উল্টে মাফ করে দিয়েছিল তাকে। নিজেকে বলেছিল, কোনো কোনো মানুষ এমন। গর্তে লুকিয়ে থেকে ভাবে, দিনটা আজ বড্ড ঠান্ডা। কোথা থেকে এত শীত পড়ল। কুয়াশা এমন ঘন কেন? দৃষ্টি বেশি দূরে ছড়ানো যায় না। ওদের মাথা কোনো দিনই আকাশসমান হয় না।
জেবুন্নেসা আরও বলেছিল, মরার আগে ভালোবাসা বুঝেছি। আরেক জীবনে ঠিকই মারুফের সঙ্গে দেখা হবে আমার। আবার প্রেমের কথা শুনব ওর কাছ থেকে। বলব, স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছিলাম। এবার প্রেমের জন্য জীবন দেব। ও ঠিকই হাসতে হাসতে বলবে, আর জীবন দিতে হবে না। এখন আমাদের শান্তির জীবন কাটবে। আমাদের সংসারের বাগানে ফুল ফুটবে। রাবেয়া খালা, ওর নাম মারুফুল হক। ওদের বাড়ি হাটখোলায়। তোমাকে আমি ঠিকানা লিখে দেব।
রাবেয়া উঠে দাঁড়ায়। সূর্যমণিকে বলে, আমার সঙ্গে আয়। এদের খেতে দেব।
আমি যাব না। ঝুলিয়ে রাখা মেয়েটাকে কী করে খাওয়াব?
পরদেশীকে ডেকে নিয়ে আয়। সবাই মিলে ধরে ওকে নামাব।
গুলি খেতে চাও? এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুলি করবে তোমাকে। মরার পথ খুঁজে বের করেছ, ভালোই।
মারলে মারবে। ওরা কিছু বললে বলব, আমরা তো তোমাদের জন্য ওকে সুস্থ রাখতে চাই। সে জন্য ওকে খেতে দিয়েছি।
ওরা বলবে, আমাদের লাশ দরকার নাই। দশটা যাবে, আমরা আবার নতুন দশটা আনব।
রাবেয়া ওকে ধমক দিয়ে বলে, তোর কাছে এসব কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে না, সূর্যমুখী। লাথি মেরে তোকে দোতলা থেকে ফেলে দেব।
যা খুশি কর। কিন্তু আমি পরদেশীকে এখানে ডেকে আনতে পারব না।
তাহলে তুই আর আমি কাজটা করব।
, সেটাও আমি পারব না। তোমাকেও করতে দেব না।
কেন? রাবেয়া দুহাত কোমরে দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে।
এরা আমাদের কাউকে বাঁচতে দেবে না। এই মেয়েগুলোকেও না। তুমি বলেছ ওদের একজন একজন করে ছেড়ে দিতে পারলে দেবে। ওরা যুদ্ধ করতে যাবে। বলোনি?
বলেছি তো। সুযোগমতো ছেড়েও দেব।
তাহলে চিন্তাভাবনা করে এগোনো ভালো না?
রাবেয়া চুপ। তারপর মাথা নাড়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জেবুন্নেসার কাছে গিয়ে বলে, কেমন আছ?