পরদেশী চলে গেলে রাবেয়ার মনে হয়, ও ভয় পেয়েছে। পরদেশী বেশি কিছু ভাবতে পারছে না। জেবুন্নেসা একটি চিঠিই তো লিখবে। ওর যাকে খুশি তাকে, তাতে কী এসে-যায়। ওর দুঃখ আছে, কষ্ট আছে, অপমানের জ্বালা আছে। স্বাধীনতার জন্য প্রতিজ্ঞা আছে। এত কিছু বুকে নিয়ে ও এখানে কেন বন্দী থাকবে। রাবেয়া আঁচল নেড়ে বাতাস লাগানোর চেষ্টা করে। বৈশাখের শেষ। দারুণ গরম পড়েছে।
চা আর একটা করে ডালপুরি নিয়ে ফিরে আসে পরদেশী। ডালপুরি দেখে খুশি হয় রাবেয়া।
ডালপুরি এনেছিস? কী যে মজা! ডালপুরি দেখেই বুঝেছি যে খিদে পেয়েছে। সে জন্য পেটটা মোচড়াচ্ছে।
ও ডালপুরিতে কামড় বসায়। পরদেশী আড়চোখে ওর খুশি মুখ দেখে। কিছু বলে না। নিজের ডালপুরি আর চা খেয়ে শেষ করে। তারপর আস্তে করে বলে, ক্যানটিনের মিলিশিয়া সেপাইটা তোকে উদ্দেশ করে বলেছে, ওই মেয়েলোকটার সঙ্গে তোকে যদি বেশি কথা বলতে দেখি, তাহলে অফিসে নালিশ দেব। তখন দেখবি গুলি খেয়ে মরবি। এখন থেকে সাবধান হয়ে যা।
তুই বললি?
তুই তো জানিস, ওদের সঙ্গে কথা বলতে আমার ঘেন্না হয়। আমি কিছুই বলিনি। চা নিয়ে সোজা তোর কাছেই তো চলে এলাম। দেখুক কথা বলি কি বলি না।
ঠিক আছে, যা খুশি করুক। অত ভয় পাই না। তবে এখন থেকে আমরা ব্যারাকের পেছনে বসে কথা বলব।
জায়গা খোঁজার দরকার নেই। যেখানে কাজ সেখানেই কথা হবে। আমাদের তো কথা বলতে হবে। আমাদের মেয়েগুলো স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিচ্ছে আর আমরা কথাও বলব না?
ঠিক বলেছিস। যাই।
রাবেয়া আর পরদেশীর দিকে ফিরে তাকায় না। আঁচল দিয়ে নিজের মুখহাত মুছে নেয়। ঝাড় নেয়, সেটা বগলের নিচে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। সিঁড়ির মুখে সূর্যমণির মুখোমুখি হয় রাবেয়া। ওকে দেখে থমকে দাঁড়ায় সূর্যমণি। চোখ মুছতে মুছতে বলে, আর চাকরি করব না ঠিক করেছি। এত নির্যাতন সহ্য হয় না। আমি ভাত খেতে পারি না। রাতে ঘুমোত পারি না।
চুপ কর, সূর্য। কী করছে ওরা?
পরিষ্কার করে দেওয়ার পর একটু স্বস্তিতে আছে।
ঘুমোতে পারছে?
কেউ কেউ চোখ বুজেছে।
তাহলে এখানে একটু বসি। ওরা একটু ঘুমিয়ে নিক।
জেবুন্নেসা তোমাকে খুঁজছিল।
রাবেয়া চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস টানে। সূর্যমণিকে জেবুন্নেসার কথা বলা হয় না। যেটুকু পরদেশীকে বলেছে, সেটুকু আর কাউকে বলবে না। দুজনে পাশাপাশি সিঁড়িতে বসে। রাবেয়ার কানে ভেসে আসে জেবুন্নেসার কণ্ঠ—আমি আব্বা-আম্মা-ভাইবোনের সঙ্গে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পারে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। আব্বা বলেছিলেন, এই গণহত্যার পরে আমরা আর ঢাকায় থাকব না। গ্রামে চলে যাব। তারপর কী করব দেখা যাবে। যুদ্ধে যাওয়ার পথে যাব। কিন্তু সদরঘাটে ওরা আমাকে ধরে। আব্বাকে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়। আম্মা ছোট ভাইবোনদের নিয়ে কোথায় আছে, আমি জানি না। আম্মাও জানে না আমি কোথায়। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে জেবুন্নেসা আবার বলে, মারুফও জানে না আমি কোথায়। মারুফের সঙ্গে কি আমার আর দেখা হবে? মারুফ কোথায়, তা আমি জানি। ও কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে আছে। ও আমাকে বলেছিল, যুদ্ধ শুরু হলে ও দেশে থাকবে না।
রাবেয়া মৃদু হেসে বলেছিল, মারুফের সঙ্গে তোমার পেরেম না?
ও ঘাড় নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ। ছয় মাস আগে ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় ও আমাকে বলেছিল, আমরা একসঙ্গে যুদ্ধ করব, জেবু। আমি বলেছিলাম, যুদ্ধ হবে তুমি তা কী করে জানলে? ও শপথের মতো করে বলেছিল, এই ভাষণের পরে যুদ্ধ না হয়ে পারে না। যুদ্ধ হবে। দেশও স্বাধীন হবে। রাবেয়া খালা, মারুফ তো আমাকে আর খুঁজে পাবে না, না?
রাবেয়া চুপ করে ছিল। রাবেয়া নিজেও বোঝে, এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না। জেবুন্নেসাও বোঝে যে উত্তর হয় না। পুরো সময়টাই অনিশ্চয়তায় ভরা। কোথায় কাকে কখন পাওয়া যাবে, এ কথা কেউ জানে না।
জেবুন্নেসা ওর হাত ধরে বলেছিল, তুমি আমার একটা চিঠি মারুফকে পৌঁছে দেবে, রাবেয়া খালা?
চিঠি? কোথায় পৌঁছাব? মারুফকে তো আমি চিনি না।
মারুফের বাড়িতে পৌঁছাবে। ওকে তোমার চিনতে হবে না। ওর বাড়িতে ওর বাবা-মা, বোন থাকে। ওনাদের কারও হাতে চিঠিটা দিয়ে আসবে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে মারুফ জানতে পারবে যে আমি নেই। আমি শহীদ হয়েছি।
ঠিকানা আছে?
সব দেব। তুমি আমাকে কাগজ-পেনসিল জোগাড় করে দিয়ো। দেবে তো, খালা? তোমার পায়ে ধরি, খালা। মরার আগে তুমি আমার এই ইচ্ছাটা পূরণ করো।
এখনো জেবুন্নেসার অনুরোধ দুকান ভরে বাজে রাবেয়ার কানে। ব্লাউজের ভেতরে এক টুকরো কাগজ আর পেনসিল রাখা আছে। ওরা দেখতে পায়, ওদের খেতে দিতে তিন-চার বালতি ভরে ভাত-ডাল-তরকারি আনা হচ্ছে। এখন ওদের খাওয়ার সময় হয়েছে। রাবেয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আবার জেবুন্নেসার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, খালা, আমি মরে গেলে তুমি আমার কথা মারুফকে বলবে। নাকি বলা ঠিক হবে না? আমার এই দুর্দশার কথা শুনতে বোধ হয় ওর ভালো লাগবে না, খালা। থাক, তোমাকে কোনো কথা বলতে হবে না। আমি জানি, ও ওর স্মৃতি থেকে আমাকে সরাতে পারবে না। ও বলেছে, আমার সঙ্গেই ওর প্রথম প্রেম। আমিও মারুফ ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসার কথা বলিনি। ওর সঙ্গে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় হয়। আর্টস বিল্ডিংয়ের দোতলায় প্রথম কথা হয়।