ওরা এলে তোর ভয় করে না, মেরিনা? মনে হয় না একটা কিছু ঘটে যেতে পারে?
মোটেই না। ওরা কবে আসবে আমিও সেই অপেক্ষায় থাকি। জানো ভাইয়া, ওরা না এলে আমার দিনগুলো ভুতুড়ে হয়ে যায়। মনে হয়, এই শহরের গেরিলারা কোথায় হারাল।
মারুফের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললে প্রথমে মারুফের চোখ কুঁচকে যায়। তারপর দৃষ্টি প্রসারিত হয়। মৃদু হেসে বলে, আমি তো জানি, মা শুধু ওদের দেবদূত বলে না। তুইও বলিস। যুদ্ধ মানুষের চেহারা বদলে দেয় রে। তবে শুধু দেবদূত নয়, তাকে ইবলিসও দেখতে হবে, মেরিনা।
আমি তা-ও জানি। পাকিস্তানি আর্মির সৈনিকগুলো আমার সামনে ইবলিস। সময়টা এখন এমনই। তোমার কি মনে হয় না, ভাইয়া, যে একদিন এই সময়ের একটা নাম হবে।
হতে পারে। আমরা যে সময় দেখছি এবং যেসব দিন পাড়ি দিচ্ছি, তার নাম হতেই হবে।
কী নাম হবে বলে তোমার মনে হয়?
মারুফ একমুহূর্ত মাথা ঝাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে, হুররে, পেয়েছি!
বলো, কী নাম হতে পারে?
মারুফ বুক টান করে দাঁড়িয়ে বলে, একাত্তর।
বাহ, দারুণ! একটি শব্দে পুরো যুদ্ধের ইতিহাস।
আমরা, গেরিলারা ঢাকা শহরের চেহারাই বদলে দিলাম। শরীরের ভেতর মেশিনগানের শব্দ টের পাচ্ছি। না, শুধু মেশিনগান হবে কেন, সব অস্ত্রের শব্দ টের পাচ্ছি। একটি ট্যাংক বা বোমারু বিমানও আমার ভেতরে ভরেছি।
একজন গেরিলাযযাদ্ধার এত আনন্দ হয়, আমি তা ভাবতে পারি না। আমার নিজেরও এমন আনন্দ হচ্ছে।
ভুলে যাচ্ছিস কেন তুই নিজেও একজন যোদ্ধা।
ভুলিনি, একদম ভুলব না। নিজের বীরত্বকে কে অস্বীকার করতে চায়?
প্রাণখোলা হাসিতে নিজেকে ভরিয়ে দিয়ে আবার বলে, আজ তোমার কোনো বন্ধু আসবে, ভাইয়া?
ওরা পাঁচজন আসবে। ওদের মধ্যে তিনজন তোর চেনা। বাকি দুজন নতুন। কী রান্না হয়েছে রে?
মা জানেন। রান্নাঘরের ব্যবস্থা মায়ের। মা বলেন, এটাই তার যুদ্ধ। গেরিলাদের খাইয়েদাইয়ে তরতাজা রেখে বড় অপারেশনে পাঠানো। মারুফের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বরে ধ্বনিত হয়, ওহ্! আমাদের মা। গ্রেট মা। কত শান্তভাবে, কত মমতায় গেরিলাদের যত্ন করেন।
শুধু কি তা-ই, মা-ও গেরিলাদের অপেক্ষায় থাকেন। বলেন, ওরা এলে আমাদের বাড়িটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়। আসল যুদ্ধক্ষেত্র দেখা না হলে কী হবে, এই যুদ্ধক্ষেত্রও দেখা আমার পুণ্য রে, মেয়ে।
মারুফও জানে এসব কথা। তার পরও মেরিনার কাছ থেকে আবার শুনতে ভালো লাগে। যেন নতুন করে শোনা হলো যুদ্ধকালীন কথা। এসব কথা বারবার শুনতে হয়। যেন কোথাও বসে কেউ একজন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করছেন। বলছেন, হে পুরবাসী, শোনো, এই ইতিহাস তোমাদের নতুন জন্মের ইতিহাস। এই ইতিহাস তোমাদের নতুন জীবন রচনা করবে। হে পুরবাসী, তোমরা জয়ের প্রার্থনায় নিমগ্ন হও। কঠিন সময়কে আপন করার প্রার্থনায় মগ্ন হও তোমরা। দেখো, চারদিকে বিউগলের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তোমাদের সামনে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ।
মারুফ চারদিকে তাকিয়ে বলে, আমার মনে হলো, কেউ যেন স্তোত্র পাঠ করছিলেন।
আমার মনে হচ্ছিল বুদ্ধের বাণী, কিংবা বাইবেল থেকে পাঠ।
অথবা কোরআনের কোনো আয়াত।
মেরিনা চমকে মারুফের দিকে তাকায়।
এই কণ্ঠস্বর কোথা থেকে ভেসে আসছিল, ভাইয়া?
আমি জানি না। শুধু মনে হয়েছিল, শোনাটা আমাদের জন্য খুব দরকার। তাই দুকান খাড়া করে রেখেছিলাম। খুব পবিত্র মনে হচ্ছিল নিজেকে। এবং নিজেকে খুব সাহসীও। জীবনকে তুচ্ছ করার সাহস।
আমরা মায়ের কথা বলছিলাম। আমার মনে হয়, আমার মায়ের পূর্বপুরুষের কেউ, ধরো তার নানা বা দাদার আগের কেউ মোগল সম্রাটের সেনাপতি ছিলেন।
মারুফ হা-হা করে হেসে বলে, মায়ের সঙ্গে মশকরা করা হচ্ছে?
মোটেই না। মায়ের সাহস দেখে মুগ্ধ হই। তার ধমনিতে যুদ্ধের গৌরবের রক্তস্রোত আছে।
তুই কি মায়ের মতো সাহসী না?
আমিও গেরিলাযোদ্ধা হতে চাই, ভাইয়া। মেলাঘরে যেতে চাই। ট্রেনিং নিতে চাই।
বাদল আসুক। ওকে তোর কথা বলব। ও তোকে মেলাঘরে নিয়ে যাবে। খালেদ মোশাররফের সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, মেয়েদের একটি প্লাটুন করুন, স্যার। আমি অনেক মেয়ে এনে দেব। শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও পারে।
মেরিনা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, মা অন্য কথা বলে।
কেমন, কী কথা রে? মা আর অন্য কথা কী বলবেন?
মেরিনা চুপ করে থাকে। খানিকটুকু দ্বিধা ওকে বাধাগ্রস্ত করে।
বলছিস না কেন? এখন চুপ করে থাকার সময় নয়। এই সময়টা কথা বলে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের সময়।
মেরিনা ঘাড় ঘুরিয়ে সরাসরি মারুফের দিকে তাকায়। কপাল কুঁচকে রাখে। ঠোঁট কামড়ায়। বলে, মা বলে, আমি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়লে ওরা আমাকে বাংকারে নিয়ে যাবে। সে জন্য সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।
ঠিকই বলেন। যুদ্ধকালে এর জন্যও তৈরি থাকতে হবে।
আগেকার দিনের নারীরা যুদ্ধে পরাজিত হলে আত্মাহুতি দিত।
মারুফ বোনের মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকায়। মেরিনা শক্ত কণ্ঠে বলতে থাকে, তবে সময় এখন আগেকার দিনের মতো নেই। এখনকার সময়ের মেয়েরা নির্যাতিত হলেও যুদ্ধের পক্ষে কাজ করবে। বাংকার থেকে বেরিয়ে এসে যোগ দেবে মুক্তিযযাদ্ধাদের সঙ্গে। বলবে, জনযুদ্ধ প্রতিটি মানুষের সাহস চায়। তোমাদের প্রয়োজনের কথা আমাকে বলো। আমি কাজটি করব। নদীর ওপর যে সেতুটি আছে, তা আমি উড়িয়ে দিয়ে আসি? তাহলে পাকিস্তানি সেনারা আর এপারে আসতে পারবে না। আমাদের এলাকা মুক্তাঞ্চল থাকবে।