আর তো সইতে পারি না, পরদেশী।
পরদেশী নিজের কাজ করতে করতে এবং মাথা তুলে না-তুলে কঠিন গলায় বলে, পারতে হবে। যুদ্ধ কী, আমি জানি না। শুধু বুঝি, শত্রুরা এমন করে।
তাহলে যে মেয়েটা মরে গেছে, সে কি শহীদ?
কী বললি? আরেকবার বল।
ও কি শহীদ? ওকে কি শহীদ বলবে স্বাধীন দেশের মানুষ?
শহীদ! শহীদ! কী যে যা তা ভাবিস না। এখন এসব কি ভাবা ঠিক। আমি জানি না। ওদের শহীদ বলা হবে কি না।
পরদেশী হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। রাবেয়াকে অন্য রকম লাগছে। রাবেয়াও হয়তো একদিন শহীদ হয়ে যাবে। পরদেশী চারদিকে ঝড়ের তোলপাড় অনুভব করে।
রাবেয়া অসহায়ের মতো বলে, কে আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেবে। তাহলে কাকে জিজ্ঞেস করব?
কাউকে না। কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে না। চুপ করে থাক। মুখ আটকে রাখ।
পরদেশীকে বিভ্রান্ত দেখায়। এই মুহূর্তে ওকে চিনতে পারছে না রাবেয়া। ও তখন দুহাত ওপরে তুলে হাতের ঝাড় শূন্যে ঘোরায়। বলে, ঝড় তুলব। একটা বড় ঝড়।
পরদেশী ধমক দিয়ে বলে, থাম, রাবেয়া। এমন করলে তোর দিকে একটা গুলি ছুটে আসবে। তুই মরবি। তখন মেয়েগুলোকে দেখবে কে? এই যে গুমুত সাফ করছিস, এটাও তোর যুদ্ধ।
যুদ্ধ? মিথ্যে কথা। ওই শয়তানগুলোর দিকে কামান দাগতে না পারলে আমার আর যুদ্ধ কী!
রাবেয়া সোজা রাস্তা ধরে দৌড়াতে থাকে। ও কোথায় যাবে? যেখানে খুশি সেখানে যাক, পরদেশী ভাবে। ওর ড্রেন পরিষ্কার করতে সময় লাগবে। ও কাজে মন দেয়। বুকের ভেতরে কষ্ট। পঁচিশের রাতে লাইনের পুলিশদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলে যুদ্ধ করা যেত। এখন ও কী করবে? ওর ভাবনা ফুরোয় না। পরমুহূর্তে ভাবে, ওর যাওয়া উচিত নয়। ও গেলে মেয়েগুলোকে দেখবে কে? মেয়েগুলোর যদি ওকে কোনো কারণে দরকার হয়? যদি কোনো কাজের কথা বলতে চায়? সেই জরুরি কাজটি করতে পারলে ওর এই পুলিশ লাইনে থাকা সার্থক হবে। এটিও যুদ্ধের কাজ। ওর দিনগুলো এখন ওর নিজের নয়। দিনগুলো স্বাধীনতার। দেশের স্বাধীনতার। সেদিন যদি ওর জীবনে আসে, তখন ও দেশের মানুষকে বলবে, আমাকে পুরো দেশ পরিষ্কার করার কাজ দাও। আমি দেশের সব রাস্তা ঝাড় দেব।
বাতাসের শনশন কান পেতে শোনে পরদেশী। কবে বাবা-মার হাত ধরে এ দেশে এসেছিল, কবে কতগুলো দিন ঝোড়ো বাতাসের মতো উড়ে গেল। কোনো কিছুর তো হিসাব করেনি। বেঁচে থাকা নিয়েই খুশি ছিল। বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার, তার সবকিছুই করেছিল। শুধু যুদ্ধ দেখা হয়নি। একদিন রেসকোর্স ময়দানে শেখের বেটার বক্তৃতা শুনতে গিয়ে তার কথায় যুদ্ধ টের পেয়েছিল। তার মুখে যুদ্ধ দেখেছিল। এখন যুদ্ধ দেখছে ওই মেয়েগুলোর শরীরে। পরদেশী ড্রেনের ভেতর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বোজে। শুনতে পায় আর্তনাদ। চেঁচাচ্ছে রাবেয়া। সেনাদের কেউ ওর পিঠে রাইফেলের বাট দিয়ে মেরে বলছে, এধার কিউ আয় হ্যায়? কাম মে যাও। রাবেয়া মাটিতে পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। পরদেশী ড্রেন থেকে উঠে রাবেয়ার দিকে যেতে চাইলে একজন ওর দিকে বন্দুক তাক করে চেঁচিয়ে বলে, খবরদার। খামোশ! পরদেশী থমকে দাঁড়ায়। দু-চার পা পিছিয়ে ফিরে আসে ড্রেনের কাছে। সারা দিন রাবেয়ার সঙ্গে ওর আর দেখা হয় না। ভাবে, রাবেয়া কি একদিন শহীদ হবে!
এর কয়েক দিন পর রাবেয়া ওকে জেবুন্নেসার গল্প বলে। বলে, জেবুন্নেসার জন্য ছুরি কিনতে হবে। বেশি বড় নয়, কিন্তু শক্তপোক্ত এবং খুবই ধারালো। যেন অনায়াসে পেটের ভেতর ঢুকে যায়। কিনতে হবে আজই। দেরি করার সময় নেই। আজই।
আজই কেন? আজ কি বিশেষ দিন যে আজই কিনতে হবে।
বিশেষ দিনটিন বলে কিছু নেই। ও ওর যুদ্ধ শেষ করতে চায়। ও আর দিন গড়াতে চায় না। বুঝলি?
পরদেশী একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলে, তাহলে আমাদের উচিত ওকে অস্ত্র দেওয়া। ওরা যত মরবে, যুদ্ধ তত বাড়বে।
হ্যাঁ, আমাদের উচিত। আজই কিনতে হবে। আমিও চাই না এমন যন্ত্রণা সহ্য করে ওরা বেঁচে থাকুক। যুদ্ধ যখন করতেই হবে হয়ে যাক এসপারওসপার।
আমি কাজ থেকে ফিরেই দোকানে যাব। কোনো সময় নষ্ট করবে না। রাবেয়া আঙুল উঁচিয়ে বলে, ও আরও দুটো জিনিস চেয়েছে। বলেছে, ওর খুব দরকার।
কী? পরদেশী ভুরু কুঁচকে তাকায়। কী চেয়েছে?
এক টুকরো কাগজ আর পেনসিল।
কী করবে?
চিঠি লিখবে।
কাকে? এমন নরককুণ্ড থেকে কাকে চিঠি লিখবে ও?
তা আমাকে বলেনি। আমিও জানতে চাইনি। কেন জানতে চাইব। ওর যাকে খুশি তাকে লিখবে।
লিখতে পারবে? কেমন করে লিখবে? ওদের শরীর তো আর শরীর নেই।
মাটিতে উপুড় হয়ে লিখবে বলেছে। লিখতে পারবে ও। ওর মনের জোর আছে। সাহস আছে। খুব জেদি মেয়ে। একরোখা। মুখ বুজে যন্ত্রণা সহ্য করে। টু শব্দ করে না। বলে, শুধু প্রতিশোধ নিতে পারলে ওর যন্ত্রণা শেষ হবে। সেদিন ও প্রাণফাটা চিৎকারে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দেবে।
ভালোই তো, আমরা ওকে কাগজ দেব। পেনসিল দেব। যা চাইবে, তা-ই দেব।
আমি কাগজ আনতে গিয়েই মার খেয়েছি।
পেরেছিস আনতে?
পেরেছি। আমার এই রাউজের ভেতরে কাগজ আর পেনসিল আছে। ওকে এখনো দিইনি। ছুরির সঙ্গে একসঙ্গে দেব।
কাগজ-পেনসিল দিয়ে দে। ওর লিখতে সময় লাগবে। লুকিয়ে লুকিয়ে লিখতে হবে তো।
ও পারবে। তুই ওকে তো কাছ থেকে দেখিসনি। ওর সঙ্গে কথা বললে আমারও সাহস বাড়ে।
চা খাবি, রাবেয়া?
হ্যাঁ, চা চাই। শরীর চাঙা করতে হবে।
তুই এখানে থাক। আমি ক্যানটিন থেকে চা নিয়ে আসছি।