ও আবার দুপা ফেলে দুটো সিঁড়ি পার হয়। শরীর ভারী হয়ে গেছে। শরীরজুড়ে কাঁটা। কাঁটার খোঁচায় প্রতি মুহূর্তে টুপটুপ করে রক্ত ঝরে। এ এক ভিন্ন ধরনের যন্ত্রণা। অনুভব করা যায়, কিন্তু দেখা যায় না। রক্ত ঝরার দৃশ্যটি বারান্দার শিকে ঝুলিয়ে রাখা মেয়েদের শরীর। রাবেয়ার হাত থেকে ঝাড়ু পড়ে যায়। ও ধপ করে বসে পড়ে দুহাতে মুখ ঢাকে।
সেদিন থেকে কত কিছু দেখা হলো।
এক জীবনে অনেক কিছু দেখার প্রেরণায় রাবেয়া দু-তিন ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে মাথায় ওঠে। লম্বা বারান্দা পার হলে পাবে ঘর। সব ঘরে বন্দী আছে মেয়েরা। তখন ওর বুক ধড়ফড় করে। বুঝতে পারে, ওর দেখার সত্য যুদ্ধের স্মৃতি। এসব মেয়ের বীরত্বের সাক্ষী হয়ে ও নিজের স্মৃতির কথা বলবে সবাইকে। বলবে সবার আগে। যারা ওদের নষ্ট মেয়ে বলবে, তাদের মুখের ওপর।
তখন আর্তচিৎকার ভেসে আসে বারান্দার শেষ মাথার ঘর থেকে। ওকে কঠিন শাস্তি দিয়েছে ওরা। মেয়েটি ওকে যেন কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু বলতে পারেনি। কথা বলার আগেই ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ও কি আর বলতে পারবে? রাবেয়া দ্রুত পায়ে হেঁটে শেষ ঘরটিতে যায়। মেয়েটি পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় ঝুলে আছে। পা বেঁধে ঝোলানো হয়েছে ওকে। ওর মাথা নিচের দিকে। ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে। ও একজন সেনাকে আঁচড়ে-খামচে দিয়েছে বলে এই নির্যাতন। ঝুলিয়ে রেখে চাবুক দিয়ে পিটিয়েছে মেয়েটিকে। এভাবে ও আর কয় দিন বাঁচবে? ওর মুখ থেকে গোঙানির শব্দ বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে যে চিৎকার-তোলপাড় করেছিল চারদিক, তা এখন স্তিমিত। রাবেয়া ওর মাথার কাছে দাঁড়ায়। উল্টে থাকা চুল জড়ো করে মাথার ওপর খোঁপার মতো বেঁধে দেয়। ওর হাতের মুঠি বন্ধ। ও হয়তো একটা কিছু খামচে ধরতে চেয়েছিল। পায়নি বলে শূন্য মুঠি স্থির হয়ে আছে। ওর ন্যাংটা, বিবস্ত্র, উলঙ্গ শরীর দুলছে। রাবেয়া ওর মাথা বুকে চেপে ধরে বলে, চোখ খোলা মেয়ে। দেখো আমাকে।
মেয়েটি চোখ খুলতে পারে না। ওর চোখের পাতা ফুলে আছে। মাথা উল্টো হয়ে আছে বলে রাবেয়াকে ক্ষণিকের জন্য দেখারও সুযোগ নেই।
তুমি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলে, বলবে?
আমার মায়ের বাড়ির ঠিকানা দিতে চেয়েছিলাম তোমাকে। আমার মৃত্যুর খবরটা তাকে দিতে বলতে চেয়েছিলাম। এখন তো আর দিতে পারব না।
মুখে মুখে ঠিকানা বলল, আমি ঠিকই মনে রাখতে পারব। আমি তোমার খবর তোমার মাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারব। তুমি আমার মানিক, তুমি আমার সোনা।
কিন্তু মেয়েটি আর কথা বলে না। নিথর হয়ে যায় ওর দেহ। রাবেয়ার বুকে মাথা রেখে ঝুলন্ত অবস্থায় মরে যায় মেয়েটি। রাবেয়া কতক্ষণ ওকে বুকে রেখেছিল, ও জানে না। ওর নিথর শরীর ক্রমাগত শীতল হয়ে যাওয়ার অনুভবও ও টের পায়নি। ও শুধু বুঝেছিল, স্বাধীনতার কথা ওর বুকের ভেতরে তড়পাচ্ছে। ও চিৎকার করে বলছে, স্বাধীনতার জন্য জীবন দিলে তুমি। তোমার মাকে এ খবর কেমন করে পৌঁছাব? আমি কোথায় খুঁজব তোমার মাকে? তোমার লাশ ওরা কোথায় নিয়ে ফেলে দেবে, তা-ও আমি জানি না। আমি আর তোমাকে খুঁজে পাব না, মেয়ে।
হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে রাবেয়া। ঝুলন্ত মেয়েটির মাথার কাছে বসে পা ছড়িয়ে দেয় ও। যেন ওর দুপায়ের ওপর বালিশ রেখে মেয়েটিকে শোয়ানো হবে। আর ঘুমপাড়ানি গান গাইবে রাবেয়া। সেই গানে দাগ পড়তে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। হায় রাবেয়া, তুমি যা দেখছ, সে দেখার শেষ নেই।
একদিন জেবুন্নেসা যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলে, তুমি আমাকে একটা ছুরি দাও, খালা। আমি এভাবে মরতে পারব না। একটাকে মেরে মরতে চাই। এটাই হবে আমার যুদ্ধ।
যুদ্ধ? মাগো, তুমি যুদ্ধ করতে চাও?
হ্যাঁ, চাই তো। যুদ্ধ করে শহীদ হতে চাই। আমাকে একটা ছুরি দিলেই হবে, খালা। এদের নির্যাতনে মরে গেলে কেউ আমাকে শহীদ বলবে না, খালা।
হ্যাঁ, তা বলবে না। এত কিছু দেখে আমিও যদি মরে যাই, আমিও শহীদ হব না।
জেবুন্নেসার কাতরানো শব্দ উঁচু হয়ে ওঠে। গায়ের জোর ঢেলে চেঁচিয়ে বলে, তুমি না বলেছ যে, খালা, আমার শরীর আমার না। এই শরীর এখন স্বাধীনতার। তাহলে আমি মরে গেলে শহীদ হব না কেন? আর বেঁচে গেলেই বা আমার কী হবে? সমাজের মানুষ কি আমাকে বুকে তুলে নেবে? আমার সব ক্ষতি পুষিয়ে দেবে?
জেবুরে, তোমার কি পিপাসা পেয়েছে? পানি দেব?
না, আমার পিপাসা পায়নি। পানি দিতে হবে না। আমাকে ছুরি দাও। কাত হয়ে পড়ে যায় জেবুন্নেসা। রাবেয়া ওকে ধরতে পারে না। শুনতে পায় বাইরে বুটের শব্দ। তোলপাড় করে সেই শব্দ এগিয়ে আসছে। তারপর আর্তচিঙ্কারে ভরে যায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের প্রাঙ্গণ। রাবেয়া ঝাড়বালতি নিয়ে ব্যারাক পরিষ্কারের কাজে লাগে। দুকান ভরে শুনতে থাকে অনেক মেয়ের আর্তচিৎকার। ঘরের ভেতর গর্জন। গোঙানি। ধমক। গালি। সব মিলিয়ে যুদ্ধ রাবেয়া খাতুনের শোনার ইন্দ্রিয়কে তীক্ষ্ণ করে। ও একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। জেবুন্নেসা মরে গেলে কি শহীদ হবে? রাবেয়া আকাশপাতাল হাতড়ায়। না, এ প্রশ্নের উত্তর ওর কাছে নেই। ও মুখসুস্থ মানুষ, এত প্রশ্নের উত্তর ও কেমন করে বুঝবে। রাবেয়া ঝাড়-বালতি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামে। একবার মাথা টলে ওঠে। ও রেলিং ধরে সামলায়। দেখতে পায় পরদেশী ড্রেন পরিষ্কার করছে। এই মুহূর্তে পরদেশী ওর কাছে ছায়া। দুচারটে কথা বললেও নিঃশ্বাস ফেলা সহজ হয়, নইলে চারদিকের দম আটকানো ভয়াবহতা রাবেয়ার বেঁচে থাকার জীবনটুকু মুড়ে ফেলে। ও দ্রুত পায়ে পরদেশীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।