তখন প্রবল গোঙানির শব্দ ভেসে আসে। রাবেয়া দ্রুত পায়ে সামনে এগোয়। ও জানে, ব্যারাকে গিয়ে লাভ নেই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে, এইটুকুই। তার পরও সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি ঝাড়ু দিতে চায় না। হাত ওঠে না। বারান্দা ঝাড়ু দিতে চায়, পারে না। ঝাড়ুটা দূরে ফেলে দিয়ে ঠা ঠা রোদে বসে থাকে। যে হারামিগুলো ভেতরে আছে, ওগুলো বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত ওকে অপেক্ষা করতে হবে।
ও পুড়ে যাওয়া ব্যারাকের দিকে তাকায়। ঘরগুলো এখনো ঠিক করা হয়নি। পোড়া অবস্থায় আছে। ওই ঘরে কয়েকজন পুলিশের লাশ ছিল। ওই পোড়া লাশ সরানোর সময় পরদেশী, লালু, যাদব, সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল। এখন ওরা মাঝেমধ্যে ওই পোড়া ব্যারাকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, আমাদেরও সুযোগ আসবে। তোমরা যেখানেই থাকো, স্বাধীনতার বাতাস বুকে টেনে বলবে, ডোমেরাও আমাদের পাশে ছিল। রাবেয়ার মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে, ওই ঘরের ভেতরে আটকে রেখে দুজন পুলিশের গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দেওয়া যায় না? তাহলেই প্রতিশোধ নেওয়া জুতসই হয়।
ও নিজের দুহাত মুঠি করে ধরে রাখে। দূরের দিকে তাকায়। আশপাশে দৃষ্টি ঘোরায়। চাকরিজীবনের শেষ বেলায় এতসব মেয়ের এমন দুর্দশা দেখতে হলো। ভেবে ওর মাথার পোকা কিলবিল করে। জীবনভর ভালো কিছু জোটেনি। সে জন্য আফসোস নেই রাবেয়ার। বাবা-মা একটি বয়সী লোকের সঙ্গে বিয়ে দিল। বছর তিনেক সংসার করতে না-করতেই মরে গেল। একদিন ভরদুপুরে কাশতে কাশতে চোখ স্থির হয়ে গেল লোকটার। ছেলেটার বয়স তখন দুই শেষ হয়েছে মাত্র। সেই ছেলে বড় হলো। বিয়ে করল। মদের নেশায় বুদ হয়ে থাকতে শিখল। মাকে বলতে শিখল, পেটে ধরেছিস বলে মনে করিস না যে তোর গর্ভের ঋণ আমাকে শোধ করতে হবে। আমি তোকে ভাত দিতে পারব না। ওষুধও না। কিছু না। ও যে এসব মদের নেশায় বলে, তা নয়। জেনেশুনেই বলে। ব্যস, হয়ে গেল বুড়ির পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ। সব বুঝে চাকরিটাকে আঁকড়ে ধরল। সুইপারের চাকরি। ভালোই তো কেটেছিল দিন। কিন্তু শেষ বেলায় এসে এসব কী দেখতে হচ্ছে? নরক দেখার চেয়েও বেশি দেখা? রাবেয়া ঝাড়টা উঠিয়ে এনে নিজের পাশে রাখে। জীবনভর যা কিছু দেখা হয়নি, তার সবটুকু কত অল্প সময়ে দেখতে হলো। ও দেয়ালের গায়ে মাথা ঠেকালে ওর চোখ জলে ভরে ওঠে। একসময় দুগাল বেয়ে গড়াতে থাকে।
পঁচিশের রাতে ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এসএফ ক্যানটিনে ছিল। পাঞ্জাবি সেনারা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেয়েদের এনে ব্যারাকে জমা করতে থাকে। অনেক মেয়েকে হেডকোয়ার্টার বিল্ডিংয়ের ওপর তলায় রাখা হয়। যাদের ব্যারাকে রাখা যায়নি, তাদের বারান্দায় রাখা হয়। কখনো জিপে করে ওদের কোথায় নিয়ে গেছে ও জানে না। এক দলকে পাঁচ-সাত দিন রেখে অন্য কোথাও ছেড়ে দিয়েছে। আবার জিপ ভর্তি করে এনেছে নতুন মেয়েদের।
রাবেয়া ঝাড়টা নিজের সামনে রাখে। পা দিয়ে নাড়াচাড়া করে। ও বুঝতে পারে, ওর ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সেনাগুলোকে যদি এই ঝাড়ু দিয়ে পেটানো যেত? পিটিয়ে ড্রেনে ফেলা যেত? যদি ওদের বলতে পারত যে তোরা বেজন্মা। মানুষের বাচ্চা না। তাহলে পৃথিবীর সবটুকু শান্তি ওর সামনে এসে পাহাড় হতো। ওই মেয়েটিকে একটা ছুরি দিলে কি হয় যে ওদের আঁচড়েকামড়ে ব্যতিব্যস্ত করে? রাবেয়ার চোখ জ্বলে ওঠে। ও ঠিক করে, মেয়েটিকে একটি ছুরি দেবে। ছোট একটি ছুরি। ওদের হাতে নির্যাতিত হয়ে মরে যেতে মেয়েটির খুব লজ্জা হচ্ছে। এমন কথা ও রাবেয়াকে বলেছে। বলেছে, মরে যেতে আমার ভয় নাই। কিন্তু কিছু না ঘটিয়ে মরতে চাই না। একটাকেও যদি জবাই দিতে পারি, তাহলে বুঝব স্বাধীনতার জন্য কিছু করেছি।
রাবেয়া আঁতকে উঠে বলেছিল, এই যে শরীর দিচ্ছ, এটা কিছু করা নয়? এটাও তো স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। যুদ্ধ না বাধলে তোমাকে এখানে আটকাত কোন শালা।
যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েছিল মেয়েটির মুখ। নিজেকেই বলেছিল, দেশের মানুষ কি যন্ত্রণাকে যুদ্ধ বলবে?
ঝাড়ু নাড়াচাড়া করতে করতে রাবেয়া ভাবে, একটি ঘটনা ঘটিয়ে মরুক মেয়েটি। ওকে ধরে নিয়ে আসার পর থেকে মেয়েটি তো ফাইট করছে। একটুও না দমে ফাইট করতে যা বোঝায়, তা-ই করছে। একটি ঘটনা ঘটাতে পারলে ওর আত্মা শান্তি পাবে। হঠাৎ নিজের ভাবনায় চমকে ওঠে রাবেয়া। ভাবে, যুদ্ধের সময় কারও আত্মা কি শান্তি পায়? স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নাই।
ও দেখতে পায়, তিনজন সেনা হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। ওদের বুটের শব্দে স্তব্ধ হয়ে যেতে চায় রাবেয়ার হস্পন্দন। তার পরও শব্দ ওকে আড়ষ্ট করে রাখে। ওর দুচোখে বিদ্যুতের আলো চমকায়। ওরা এসব মেয়ের কাছে যখন-তখন আসে। যখন খুশি তখন। যেন উল্লাস করবে বলে ওদের যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছে। যুদ্ধ মানে মেয়েদের শরীর ছিঁড়ে-খুবলে খাওয়া। রাবেয়া দাঁড়িয়ে থেকে তিনজন সেনাকে চলে যেতে দেখে। ও জানে, একটু পর আবার কেউ আসবে।
ও সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। দুপা ফেলার পর মনে হয় উঠতে পারছে না। শব্দ ওকে পিছু টেনে ধরে, বিকট শব্দ। ঝমঝম করছে শব্দের তাণ্ডব। কাঁপছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের এসএফ ক্যানটিনে লুকিয়ে ছিল রাবেয়া। একদিকে হামলা, অন্যদিকে পুলিশদের বাধা দেওয়া। সারা দিন ব্যারাক ঝাড়ু দিয়ে সেদিন আর বাড়ি ফিরতে পারেনি। দিনভর উত্তেজনা ছিল। রক্ত গরম ছিল সবার। পুলিশ ভাইদের অস্ত্রের ঘর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ওর বারবার মনে হচ্ছিল, এত কিছু ছেড়ে বাড়ি যাবে কেন? যুদ্ধ তো ওকেও করতে হবে। যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ওরা এসেছিল কামান, গোলা, বোমা, ট্যাংক নিয়ে। কানফাটা গর্জনে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল চারদিক। ও ধরে নিয়েছিল, শেখের বেটার ভাষণের পর এত দিনে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ও এখন একটা পরিপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে আছে।