দুজন সুইপার ড্রেনের ভেতর পা ঝুলিয়ে বসে। খুব অল্পক্ষণের জন্য। এটুকু সময়ই ওদের জীবনে এক বিশাল সময়। সময় প্রাণ খুলে কথা বলার এবং শেখের বেটা যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে, সেই স্বাধীনতার মর্ম বোেঝার। ওরা দুজনেই দুহাতে ঝাড়ু ধরে রাখে, যেন কোনো দিক থেকে ডান্ডা হাতে মিলিশিয়া জওয়ান এলে বলতে পারে আমরা তো কাজ করছি। পরদেশী হাসতে হাসতে বলে, কেউ এলে আমি লাফ দিয়ে ড্রেনে নেমে যাব। পানি ঝাড়ু দিতে দিতে বলব, দেখো, কাজ করছি।
আর আমি কী করব? আমার জন্য তোর পরামর্শ কী, শুনি?
তুই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবি। মাথা নড়বে না। কোনো দিকে তাকানো চলবে না।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব কেন?
আকাশের তারা গুনবি।
দিনের বেলা কি তারা দেখা যায়?
কষ্ট সইতে হলে দিনের বেলা তারা খুঁজতে হবে, রাবেয়া। দেখবি বুকের ভেতরের কষ্ট তারার মতো লুকিয়ে আছে। কষ্টের কাছে তোর কোনো হার হবে না।
রাবেয়া অবাক হয়ে পরদেশীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিস্মিত দৃষ্টি ওর মুখের ওপর স্থির রেখে বলে, তুই এত কিছু বুঝিস, পরদেশী? আগে তো কখনো টের পাইনি।
মাঝে মাঝে বুঝি। সব সময় বুঝি না। শুধু এইটুকু বুঝি, আমাদের জীবনে স্বাধীনতা হলো পেট পুরে ভাত, নয়তো রুটি খাওয়া। লাল জামা কেনা। নীল লুঙ্গি পরা। মদ খাওয়া। গা ছেড়ে ভুঁড়ি ফুলিয়ে ঘুমানো। বেঁচে থাকার যা কিছু দরকার, স্বাধীন দেশে তার সবটুকু চাই। মাথার ওপর কেউ ছড়ি ঘোরাবে না। বানচোত, শুয়োরের বাচ্চা বলে গাল দেবে না।
আর কিছু না?
হয়তো আরও অনেক কিছু, কিন্তু আমি জানি না। মুখসুখ মানুষ, এত কিছু বুঝব কী করে!
আমিও জানি না। শেখের বেটা যেদিন সাতই মার্চের ভাষণ দিল রেসকোর্সে, সেদিন আমি সেটা শুনতে আসছিলাম। সুইপার কলোনির অনেকে এসেছিল। আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে। এটুকু বলে রাবেয়া বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, তার পরও আমরা স্বাধীনতার কথা বেশি জানি না।
রাবেয়ার কণ্ঠস্বর এবং চেহারার বিষণ্ণতায় মন খারাপ হয় পরদেশীর। ও অন্যদিকে তাকায়। ঝাড়ুটা পা দিয়ে নাড়ায়। ভাবে, এটা যদি একটা রাইফেল হতো, নয়তো মেশিনগান। ওর বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
দুজনে আকস্মিকভাবে শুনতে পায় নারীকণ্ঠের আর্তনাদ। একটি-দুটির নয়, অনেকগুলোর একসঙ্গে। রাবেয়া পরদেশীর হাত চেপে ধরে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, কী হলো রে মেয়েগুলোর? কখনো তো একসঙ্গে এমন জোরালো চিৎকার শুনিনি।
পরদেশী রাবেয়াকে হাত টেনে বসিয়ে দিয়ে বলে, আর কী হবে। রোজ যা হয়, তা-ই হচ্ছে। ভোগ করার পরে হয়তো চাবুক দিয়ে পেটাচ্ছে।
আজ বেশি চেঁচাচ্ছে ওরা। ছেড়ে দে আমাকে, আমি ব্যারাকের দিকে যাই। দেখি, কতটা নরক বানিয়েছে। তুই ড্রেন সাফ কর।
ঠিক আছে, যা। তোর ওদের কাছে যাওয়াই দরকার।
তখন সুইপার লালু অন্যদিক থেকে ওদের কাছে এসে দাঁড়ায়। ক্রোধে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, সইতে পারি না। দু-একটা অস্ত্র পেলে দিতাম সবগুলোকে সাবাড় করে।
রাবেয়া রুখে দাঁড়িয়ে বলে, আমারও তা-ই মনে হয়। পঁচিশ তারিখে রাজারবাগের পুলিশরা যেমন কিছুক্ষণের জন্য ওদেরকে রুখে দিয়েছিল, ঠিক তেমন। চল না, আমরা অস্ত্র জোগাড়ের চেষ্টা করি।
কথা খালি মনে করাস না, রাবেয়া। মনে করব, কিন্তু কিছু করতে পারব। না, তাহলে তো একটা নেংটি ইদুর হয়ে যাব।
রাবেয়া কথা আরও এক ধাপ বাড়িয়ে বলে, সেদিন পুলিশরা অস্ত্র পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্রের ঘর ওদেরকে খুলে দেওয়া হয়েছিল।
পরদেশী উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তুই থাম, রাবেয়া। বাকি কথা আমি মনে করি। সেনারা যখন উত্তর দিকের টিনশেড ব্যারাকে বোমা আর পেট্রল ধরিয়ে দিয়েছিল, তখন কয়েকজন পুলিশ আগুনে পুড়ে যায়। আহা রে, এক দিন পরে সেই সব লাশ দেখে আমার বুকের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিল রাগে-দুঃখে। সেদিন আমি ভয় পাইনি। কিন্তু অত মৃত্যু দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। আমি লাশ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। নিজেকে বলেছিলাম, প্রতিশোধ নেব। কতটুকু পারব তা আমার মাথায় ছিল না। জেনেছিলাম, এই মুহূর্তে আমাকে লাশ সরাতে হবে। আমি কাঁদতে কাঁদতে লাশ টেনেছিলাম। আমার চোখের জল বুকের আগুন নেভাতে পারেনি। নেভাতে কেউ পারবে না। বুড়িগঙ্গা নদীও না। জন্মেছি ডোম হয়ে। এ জীবনের সাধ আর মিটল না।
দুঃখ করিস না, পরদেশী। দুঃখ করলে হেরে যাব। মনে জোর রাখ।
লালু ওর হাত চেপে ধরে।
ফুহ, দুঃখ করব কেন? দেশের স্বাধীনতা দেখতে পেলে এই জীবনের আয়ু গোনার দিন শেষ হবে। আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।
কথা শেষ করে আর দাঁড়ায় না পরদেশী। ঝাড়টা বগলের নিচে চেপে ধরে অন্যদিকে চলে যায়। লালু আর রাবেয়া তাকিয়ে থাকে। মাস ছয়েক আগে পরদেশীর বউ মরে গেছে। ঘরে তিনটে বাচ্চা আছে। বাচ্চাগুলোকে ওর মা দেখে। ওর মা বুড়ো হয়েছে। এখন মায়ের বিশ্রামের সময়। সারা জীবন ঝাড় দিয়ে দিয়ে কুঁজো হয়ে গেছে। মায়ের কষ্ট পরদেশীর সহ্য হয় না; কিন্তু উপায় নেই। বাচ্চাগুলো অবশ্য বেশি ছোট নয়। দু-এক বছরে ঝাড়া হাত-পা হবে। মায়ের জন্য ভীষণ মায়া হয় পরদেশীর। বুড়িটা আর কত দিন বাঁচবে? স্বাধীনতা দেখতে পাবে তো! পরদেশী শিরীষগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝাড়ুটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে নিজেকে নিষ্পেষণ করে।