থরথর করে কাঁপে ফয়েজের শরীর। বুঝতে পারে, জয় বাংলা মামণি ওর শরীরের সবটুকু শক্তি কেড়ে নিচ্ছেন। ও দুহাতে টেলিফোন রিসিভার ধরে রাখে।
টেলিফোন ওঠায় কায়েস। টেলিফোনে কোনো রিংটোন ছিল না। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল, কোথাও কিছু ভুল হয়েছে বোধ হয়। টেলিফোনে মেসেজ আসার কথা। ও জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। দেখতে পায় দিনের প্রথম আলো ফুটছে। মায়াবী আলো ওর দুচোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ করে। কায়েস বাইরে ছুটে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়। টেলিফোনের অদৃশ্য ধ্বনি ওর পথ রোধ করে। ও রিসিভার ওঠায়—আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?—জয় বাংলা মামণি ওদের পথে আলোর হাতছানি। ওরা তো তার কাছে পৌঁছেই যাবে। কায়েসের মা এসে ওর কাছে। দাঁড়ালেন। এত ভোরে উঠেছিস কেন রে? আগের মতো কি আমাকে কিছু না বলে পালিয়ে যাবি বাড়ি থেকে? না মা, এবার তোমাকে বলেই যাব। কার সঙ্গে কথা বলছিস? শোনো কার সঙ্গে-গুনগুন ধ্বনিতে ঝংকৃত হয় :
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ
ছিড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
ব্যাপার কিরে? কে তোদের ডাকছে? সব মায়েরা। সব মায়েরা আমাদের স্বাধীনতার জন্য ডাকছে। কায়েস দুহাত ওপরে তুলে মায়ের চারপাশে পাক খায়।
বাবার হাত থেকে টেলিফোন নেয় ওমর। তখন মধ্যদুপুর। ভাত খাওয়ার সময়। বাবা ওকে বলেন, তোর ফোন, ওমর। কেউ তোকে খুঁজছে। এবার যদি বাড়ি থেকে যাস তাহলে আমাদের বলে যাবি। লুকিয়ে পালাতে হবে না।
না, বাবা, লুকিয়ে পালাব না। রিসিভার কানে লাগায় ওমর :
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার…
গুনগুন ধ্বনি ওকে আচ্ছন্ন করে। ওর মনে হয়, ঘরে সবাই এসে জড়ো হয়েছে। হাতে রাইফেল কিংবা লাইট মেশিনগান, নয়তো গ্রেনেড। সবাই মিলে গাইছে :
দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার!
গান শেষে সবাই স্যালুট করে বলে, আমরা তৈরি। জয় বাংলা।
০৩. শহরে গেরিলা অপারেশনের খবর
শহরে গেরিলা অপারেশনের খবর পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সুইপার রাবেয়া। ড্রেন পরিষ্কার করার কাজ রেখে ওকে কাঁদতে দেখে সুইপার পরদেশী জিজ্ঞেস করে, রাবেয়া, কী হয়েছে তোর? হঠাৎ এমন কাঁদতে শুরু করলি কেন?
বুকে ব্যথা হচ্ছে। ব্যথায় মাথাও জানি কেমন করছে?
বুকে ব্যথা নিয়ে এত জোরে কাঁদতে পারে মানুষ? তুই তো দেখছি একটা উল্লুক। এমন উল্লুক আমি একটাও দেখিনি। তুই আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছিস। বল, তোর কী হয়েছে?
রাবেয়া কথা না বলে কাঁদতে থাকে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকে। কান্নায় ওর শরীরে প্রবল ঝাকুনি। কান্নার দমকে মাঝেমধ্যে হেঁচকি উঠছে। দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। মাঝেমধ্যে কাশছে। পরদেশী রেগে ওর দিকে তাকায়। একসময় নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে, থাম বলছি। রাবেয়া থামে না। থামার জন্য প্রস্তুতিও নেয় না। কান্না যেন তাকে পেয়ে বসেছে।
পরদেশী ভুরু কুঁচকে বলে, কী হলো, কান্না থামা। নইলে তোকে ঘুষি মেরে ড্রেনের মধ্যে ফেলে দেব।
রাবেয়া ভেজা চোখে পরদেশীর দিকে তাকায়। চোখভরা পানি দেখে পরদেশী বিপন্ন বোধ করে। রাবেয়া চোখ মুছে আস্তে করে বলে, রাগিস না। এখন আমাদের রাগের সময় না। নিজেদের নিজেদের রাগারাগি আমাদের সর্বনাশ করবে।
উপদেশ দিস না, রাবেয়া। উপদেশ শুনে মেজাজ গরম লাগছে। কী হয়েছে, বল?
আমি কি কাঁদি সাধে? দেখিস না সেই কাল রাতের পর থেকে ওরা কত কত মেয়ে ধরে নিয়ে এসে পুলিশ লাইনের ব্যারাকে ভরে ফেলেছে। ওদের গু-মুত সাফ করতে আমি যাই। তোকে যেতে হয় না, পরদেশী। তুই তো শুনতে পাস না যে কত যন্ত্রণায় ওরা চিল্লায়।
চুপ কর, চুপ কর, রাবেয়া। আমি সইতে পারি না। আমাকে তোর বলে বোঝাতে হবে না।
তাহলে শোন, তুই তো আমাকে কতবারই কাঁদতে দেখেছিস। সেই কান্না ছিল কষ্টের, রাগের। তখন কেঁদেছি দুঃখে, যন্ত্রণায়। নিজের হাত কামড়ে নিজের রক্ত নিজে চুষেছি। আজ আমি কাঁদছি আনন্দে। আজ আমার আনন্দের শেষ নাই।
আনন্দ? কিসের আনন্দ তোর? তোর আজকে কী হয়েছে, বল তো?
হোটেল ইন্টারে গেরিলারা গ্রেনেড ফাটিয়েছে। কেউ ধরা পড়েনি। বোমা ফাটিয়ে ঠিকঠাকমতো চলে যেতে পেরেছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনেছি। তুই চুপ করে থাক, রাবেয়া। এসব শুনলে ওরা তোকেআমাকে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখবে। ন্যাংটো করে ঝোলাবে। তারপর চাবুক দিয়ে পেটাবে।
হ্যাঁ, জানি। এমনই করবে ওরা। সে জন্য হাসছি না, কাঁদছি। হাসির বদলে কেঁদে নিজের খুশি ফোঁটাচ্ছি। যেন ওরা বুঝতে না পারে যে আমার কী হয়েছে।
পঁচিশের প্রথম রাতে তোকে যখন নির্যাতন করল, তখন তো তুই কাঁদিসনি, রাবেয়া।
যে দুঃখ সারা জীবন বইতে হবে, তার জন্য কেঁদে কী লাভ, পরদেশী? কিন্তু কচি কচি মেয়েদের ধরে নিয়ে আসছে, এটা আমি সইতে পারছি না। আমার মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ছে। মনে হচ্ছে, মাটি ফাঁক হয়ে গেলে আমি জ্যান্ত কবরে চলে যাব। আর যদি ব্যারাকে আগুন জ্বালায়, তাহলে আমি ওই আগুনকে চিতা মনে করে ঢুকে যাব। মরেই নিজের জনম সার্থক করব।
আহ্, থাম, রাবেয়া। এত কথা কেন বলছিস। চল, এই ড্রেনের পাশে একটুক্ষণ বসি। তোর একটু দম নেওয়া দরকার। কেঁদেকেটে হয়রান হয়ে গেছিস।