মেরিনা বাথরুম থেকে ড্রয়িংরুমে এলে দেখতে পায়, আয়শা খাতুন বইটা বুকের ওপর রেখে সোফায় মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। আকমল হোসেন সেন্ট্রাল টেবিলটা সামনে টেনে নিজের বানানো শহরের ম্যাপের ওপর ঝুঁকে আছেন। মেরিনা বেরিয়ে এসে মন্টুর মায়ের ঘরে যায়। দেখতে পায়, মন্টুর মা ঘরের মৃদু আলোয় মৃদুস্বরে দোয়া পড়ছে। ও বেরিয়ে বারান্দায় আসে। আলতাফ তখনো সিঁড়ির ওপর বসে আছে। মেরিনাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়।
আপা, ভাইয়ারা কখন আসবে?
জানি না তো। আমাকে কিছু বলেনি।
এতক্ষণে তাদের তো কাজ শেষ হয়েছে, না?
সময় হিসাব করলে হয়ে যাওয়ার তো কথা।
তাহলে যেকোনো সময় আসবে। চুপিচুপি করে ডেকে বলবে, আলতাফ ভাই, দরজা খোলেন। তাই না, আপা? তাদের যে-ই আমাকে ডাকুক না কেন তার গলা আমি চিনি। তাদের নাম ধরেই আমি বলি, দাঁড়ান, দরজা খুলছি, মিজারুল ভাই। আজকে কে আমাকে ডাকবে, আপা, আপনি বলেন?
আপনিই বলেন?
আমার মনে হয়, আজকে সবাই একসঙ্গে আমাকে ডাকবে। আলতাফ ভাই, দরজা খোলেন। তাই না, আপা? ঠিক বলেছি?
হ্যাঁ, তাই তো। ঠিকই বলেছেন। ওদের নিয়ে আজ আমাদের নিজের মতো করে ভাবার সময়। সময় খুব সুন্দর।
আজ আমি বারান্দায় বসে নামাজ পড়ব। আমি কোথাও যাব না।
তাই বুঝি জায়নামাজ এনেছেন এখানে?
হ্যাঁ। আলতাফ হোসেন মাথা নেড়ে মৃদু হাসে।
সেই ভালো। আমিও দেখতে এসেছিলাম যে আপনি কী করছেন।
বাড়ির দারোয়ানের তো গেট খোলারই কাজ, আপা। কিন্তু আজকে যাদের অপেক্ষায় গেট খোলার জন্য বসে আছি, তারা সবাই ফেরেশতা। তারা যখন কাজ শেষ করেছে, তখন আমাদের ঢাকা শহরের ওপর সাদা আলো ছড়িয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এই আলো আর নিভবে না।
আলতাফ ভাই! মেরিনা অস্ফুট ধ্বনিতে একজন সাধারণ মানুষের স্বপ্নের কথা শোনে। বিস্ফারিত হয় ওর চোখ। ভাবে, এভাবে যুদ্ধ। এভাবেই স্বাধীনতার স্বপ্ন। একজন মানুষও বেঁচে থাকলে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেবে। ওহ, এই শহরে এখন আর কোনো মানুষের ভয় নাই।
রাত বাড়ে।
এখন পর্যন্ত বাড়ির টেলিফোন বাজেনি। খবরের জন্য অপেক্ষারত মানুষেরা এখন ঘরে-বারান্দায় পায়চারি করছে। আয়শা খাতুন বুকের ওপর থেকে বই সরিয়ে উঠে পড়েছেন। আকমল হোসেন সোফায় নেই। বাড়ির পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মন্টুর মা নামাজ শেষ করে রান্নাঘরে এসেছে। আলতাফ মিয়া লোহার গেটের ওপর মুখ রেখে ভাবছে, ফিরছে না কেন ভাইয়ারা? তারা এই বাড়িতে এলে সে-ও চলে যাবে তাদের সঙ্গে। যুদ্ধের সময় মানুষ কীভাবে ঘরে বসে থাকতে পারে।
তখন বাড়ির টেলিফোন বেজে ওঠে।
ছুটে যায় মেরিনা। গিয়ে ফোন ধরে।
হ্যালো, ভাইয়া।
ছুটে আসেন আকমল হোসেন, আয়শা খাতুন।
আমরা সাকসেসফুলি সব কাজ শেষ করেছি। শুধু পত্রিকা অফিসের সামনে ছোড়া গ্রেনেডটা ঠিক জায়গায় পড়েনি। আব্বাকে দে, মেরিনা।
ফোন চলে যায় আকমল হোসেনের হাতে।
বলো, বাবা–
আমরা পেরেছি, আব্বা। আমরা বিদেশিদের সামনে দেখাতে পেরেছি যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি শান্ত না। পাকিস্তান সরকার যা কিছু প্রচার করছে তা মিথ্যা।
তোমাদের জন্য দোয়া করি, বাবা। সাবধানে থাকো। জয় বাংলা।
ফোনটা মাকে দেন, আব্বা।
হ্যালো, বাবা।
মাগো, সব ঠিকঠাকমতো হয়েছে। আমার জন্য একটুও ভাববেন না। আপনি তো বলেন, দেশের জন্য আমরা সবাই জীবন দিতে তৈরি হয়েছি।
তোমার জন্য দোয়া করি, বাবা। আমি জানি, তোমার বুকভরা সাহস আছে। তুমি পিছু হটবে না।
মাগো, আমাদের সময়কে তো আমাদেরই পূর্ণ করতে হবে। ফোন রাখছি, মা। কবে দেখা হবে জানি না।
ফোনের লাইন কেটে যায়। আয়শা খাতুন একটু সময় রিসিভার বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। যেন তিনি অগণিত গেরিলাযোদ্ধার বুকের ধুকধুক ধ্বনি শুনছেন। যেন তার চারপাশে এখন আর কোনো ধ্বনি নেই, তিনি দুপা বাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের অপর প্রান্তে মারুফ।
মাগো, দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার… গানটি শোনান।
আয়শা খাতুনের গুনগুন ধ্বনি ছড়িয়ে যায় ফোনে এবং ঘরে—লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার ছড়াতে থাকে সুর :
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।…
ফোনের রিসিভার ওঠায় মিজারুল। ওর মনে হয়, জয় বাংলা মামণি ওর বুকের ভেতর সাহসের ধ্বনি ছড়াচ্ছেন। ও টেলিফোন কানে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে :
তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার…।
গুনগুন ধ্বনি উজ্জীবিত করে মিজারুলকে।
রিসিভার ওঠায় স্বপন। টেলিফোন টোনে গুনগুন ধ্বনি শুনে চমকে উঠেছিল সে। বুঝতে পারে না কোথা থেকে এমন শব্দ আসছে। ফোনের চারপাশে এ কিসের ধ্বনি! তারপর দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরে। শুনতে পায়, জয় বাংলা মামণির কণ্ঠস্বর—ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান—গুনগুন ধ্বনি ছড়াতে থাকে ঘরে। ছুটে আসে তপন। দাদা, কে গান গাইছে? তুমি টেলিফোনে কার গান শুনছ? আমাকে শুনতে দাও। ফোনের রিসিভার কেড়ে নেয় তপন। গুনগুন ধ্বনি বুকে নিয়ে স্বপন ঘরে পায়চারি করে। টেলিফোন ওঠায় ফয়েজ :
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়াছে তাঁরা
দিবে কোন বলিদান?