একটু পর আলতাফ আসে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু বলে না। আকমল হোসেন হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বলেন, কিছু বলবে?
গেট বন্ধ করে দিয়েছি। রাস্তায় লোক চলাচল খুব নাই।
বেশ করেছ। তুমি তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে পারো।
আমি শুয়ে পড়লে চলবে কেন? ভাইয়ারা কখন আসবে তার তো কিছু ঠিক নাই।
ভাইয়াদের কথা তোমার ভাবতে হবে না।
আলতাফের শরীর সোজা হয়ে যায়। খানিকটা ক্ষুন্ন স্বরে বলে, আমাকে তো ভাবতেই হবে, স্যার। গেট তো আমি খুলব। আমি ঠিক করেছি, আজ নিজের ঘরে ঘুমাব না। বারান্দায় শুয়ে থাকব, যেন গেটে শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিতে পারি।
আকমল হোসেন কথা না বাড়িয়ে বলেন, ঠিক আছে, তোমার যা ভালো মনে হয়, তা-ই করো।
আলতাফ আবারও ক্ষুন্ন কণ্ঠে বলে, বারান্দায় শোব কি না এ কথাটি জানতে এসেছিলাম।
আকমল হোসেন উত্তর দেন না। আলতাফ দরজা ছেড়ে চলে যেতে যেতে ভাবে, এ বাড়ির সবার হলো কী আজ। দুপুর পর্যন্ত উৎসবের মতো কত কিছু হলো। এখন, ধুৎ! ও আর ভাবতে চায় না। বাড়ির বাইরের সব বাতি অফ করে দিয়ে আলতাফ বারান্দার সিঁড়ির ওপর চুপচাপ বসে থাকে। ভাইয়ারা জয়ী হয়ে ফিরে আসবে এমন একটি আশায় তার মন-প্রাণ উত্তেজিত। কিন্তু বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। উঠে গেটের কাছে যায়। গেটের গায়ে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। আবার ফিরে আসে বারান্দায়। মন্টুর মা তার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। এগিয়ে দিয়ে বলে, পানি খান, আলতাফ ভাই?
আমার তো পিয়াস লাগেনি।
পানি খেলে আপনার স্বস্তি লাগবে। বুকের ভেতর ঠান্ডা হবে।
তাহলে খাই। আলতাফ গ্লাস নিয়ে পানি খায়। মন্টুর মা যেতে যেতে বলে, এখন নামাজ পড়েন। শান্তি পাবেন। নামাজ পড়ে দোয়া করেন, আমাদের ছেলেরা যেন যুদ্ধে জেতে।
ঠিক। যতক্ষণ ঘুম আসবে না, ততক্ষণ দোয়া পড়ব। যাই, জায়নামাজ নিয়ে আসি।
মন্টুর মা রান্নাঘরে গ্লাস রেখে নিজের ঘরে যায়। তার ভাবতে ভালো লাগে যে, সে মানুষটির অস্থিরতা কাটিয়ে দিতে পেরেছে। যুদ্ধের সময় মানুষকে অনেক বেশি অস্থির করে। মন্টুর মা নিজেও ছেলেদের জন্য দোয়া করবে বলে নামাজের জন্য অজু করে। জায়নামাজ পেতে বসার সঙ্গে সঙ্গে মন্টুর মায়ের বুক প্রশান্তিতে ভরে যায়। ভাবে, ছেলেরা যে যুদ্ধে গেছে, সেটায় জয়ী হয়েছে। ঠিকই জয়ী হয়েছে। দুদিন পর এ বাড়িতে আবার জড়ো হয়ে বলবে, আমরা এসেছি। আমাদের গ্রেনেড দেন। মন্টুর মা ওদের জন্য দোয়া করে।
ঘরের ভেতরে মেরিনার ভাবনার শেষ নেই। ও প্রতি মুহূর্তে সময়ের হিসাব কষছে। ওরা গাড়ি হাইজ্যাক করছে। বাড়িতে এসে গ্রেনেড নিয়েছে। ওরা এখন কোথায়? টিভিতে সন্ধ্যার খবর পাঠ করা হচ্ছে। কিন্তু গেরিলা অপারেশনের কোনো খবর নেই। নিশ্চয় কালকের পত্রিকায় ওদের খবর ছাপা হবে। আয়শা খাতুন বই পড়ছিলেন। এখন তিনি বই পড়ছেন। সন্ধ্যার আগে থেকেই তিনি চুপচাপ হয়ে আছেন। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলছেন না। মেরিনা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরও মা ওর দিকে তাকান না। ও বাবার দিকে তাকায়। দেখতে পায়, বাবা টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছেন। শব্দহীন টেলিভিশনের স্ক্রিন তিনি দেখছেন, নাকি দেখার ভাণ করে আছেন, তা বুঝতে পারে না মেরিনা। ওর মাথার মধ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পুরো চত্বর যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে যায়। সরাসরি যুদ্ধ-গোলাবারুদ, মেশিনগান, ট্যাংক ইত্যাদিসহ পুরো যুদ্ধের চিত্রটি নিজের মধ্যে জাগিয়ে রেগে মেরিনা বাথরুমে আসে। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখমুখে পানি দেয়। ভাবে, আজ তো আর ওদের কোনো খবর পাওয়া যাবে না। সময়কে এখানে থামিয়ে রাখা উচিত।
কারণ সন্ধ্যা শেষ হয়ে গেছে। এখন রাত আটটা বাজে। ওদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ওরা সব কাজ শেষ করেছে। নিশ্চিত করেছে। সময় এখন থেমে থাকুক। কোনো একদিন পুরো ঘটনা ওদের কাছ থেকে শুনতে হবে। ওরা হোটেলের দেয়াল ঘেঁষে লাগানো বড় গাছগুলোর আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকেছে। মোটা গাছের কাণ্ডের আড়ালে দাঁড়িয়ে গ্রেনেড ছুড়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের গাড়ির ওপর গ্রেনেড ফেলেছে। ওরা সমস্ত মানুষের চিত্তার দুকান ভরে শুনেছে। ওদের ছোটোছুটি দেখেছে। প্রধান গেটের সামনে গ্রেনেড ছুড়ে সিকিউরিটি গার্ডদের হতবিহ্বল করেছে। তারপর ওরা ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠেছে। গাড়ি স্টার্ট করা ছিল। গাড়ি শাঁই করে মগবাজারের শান্তি কমিটির অ্যাডভোকেটের বাড়িতে গ্রেনেড ছুড়েছে।
তারপর ওরা মর্নিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার অফিসের সামনে গিয়ে দেখেছে, পাহারা দিচ্ছে পাঞ্জাবি দারোয়ান ও মিলিশিয়া জওয়ান। ওরা একটি গ্রেনেড ঠিকই ছুড়েছে। কিন্তু ওটা ঠিক জায়গায় পড়েনি। জামার আস্তিন গাড়ির দরজার লকে আটকে যাওয়ার ফলে গ্রেনেড অন্য জায়গায় পড়ে। ওরা আর অপেক্ষা করেনি। শহর টেরোরাইজ করে, চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে ওরা যার যার পথে চলে গেছে।
মেরিনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। ভাবে, একজন গেরিলা হওয়ার সাহস নিয়ে ও এখন নিজের মুখোমুখি হয়েছে। একাত্তরের এই সময়ে সাহস দরকার—প্রতিজ্ঞা দরকার—ঘরের মধ্যে থেকে কিংবা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের মুঠোয় সময়ের সবটুকু নিতে হবে। কোনো অপচয় নয়—বৃথা সময় কাটানো নয়। ওর কপাল কুঁচকে থাকে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছে। ভাবে, সময়ের হিসাবে গেরিলারা অপারেশন শেষ করেছে। তবে ওর মায়ের কণ্ঠে গুনগুন ধ্বনি নেই কেন? মা কি ওদের স্বাগত জানাবে না? মেরিনা মন খারাপ করে। বুঝতে পারে না যে আয়শা খাতুন কী ভাবছেন। তাঁর মনে কোনো আশঙ্কা দেখা দিয়েছে কি? ভাবছেন, ছেলেরা কোনো অনিশ্চয়তায় আছে? যতক্ষণ না খবর আসবে যে সবকিছু ঠিকঠাকমতো হয়েছে, ততক্ষণ তিনি স্তব্ধ হয়ে থাকবেন। হয়তো এটাই সত্যি। তার বুকের ভেতরে সংগীত স্তব্ধ হয়ে আছে।