ওরা একসঙ্গে আকমল হোসেনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাঁর কথা থামলে ওরা একটু পরে মাথা নেড়ে বলে, ঠিক বলেছেন, খালুজান। গাড়ি চালাবে মিজারুল। তাহলে মিজারুলের সঙ্গে কায়েস আর স্বপন যাক। মারুফ, ফয়েজ
আর আমি দুর্গবাড়িতে থাকি।
হ্যাঁ, তা-ই করো।
মেরিনা উৎসাহ নিয়ে বলে, গ্রেনেডগুলো আমি গুছিয়ে দেব। কয়টি গ্রেনেড দেব, আব্বা?
আটটি। আটটির বেশি দরকার হবে না।
আমরা ঠিক করেছি, ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড ছোড়া ঠিকঠাকমতো হলে আমরা কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মির্জা শফিকুলের বাড়িতে গ্রেনেড ছুড়ব। ওর মগবাজারের বাড়ি হোটেল থেকে বেশি দূরে নয়। এক সন্ধ্যাতেই কাজটি হয়ে যাবে। মানুষকে জানানোর দিকটি জোরদার হবে। আকমল হোসেন প্লেটের ভাতটুকু শেষ করে বলেন, আতঙ্ক সৃষ্টি করার কাজটি জোরেশোরে হওয়াই ভালো।
এক গ্লাস পানি খেয়ে তিনি উঠে পড়েন।
আয়শা খাতুন বলেন, হাত ধুয়ে আবার টেবিলে ফিরে এসো। আরেকটি আইটেম বাদ আছে।
তাই নাকি? আসছি। এই ছেলেরা, তোমরাও হাত ধুয়ে নাও। আরেকটি আইটেম খাওয়া শেষ হলে তোমাদের আক্রমণের পরিকল্পনাটাও আমাকে বুঝতে হবে।
হ্যাঁ, আমরা সেটাও আপনাকে বলব।
হাত ধোয়ার জন্য কেউ কেউ রান্নাঘরে ঢোকে, কেউ টেবিলের পাশের বেসিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
সবাই ফিরে এলে কেক কাটা হয়। সবার মুখে কেকের টুকরো তুলে দেন আয়শা খাতুন। মারুফ হাসতে হাসতে বলে, মা, জন্মদিনের মোমবাতি নেই। আপনি কি মোমবাতি কিনতে ভুলে গিয়েছিলেন?
মোটেই ভুলিনি, বাবা। আজকে গেরিলাদের জন্মদিনের মোমবাতি হলো জয় বাংলা। ওই ধ্বনি আমাদের সামনে আলোর শিখা। ওটাকে ফু দিয়ে নেভানো যাবে না। এটা আমাদের সামনে জ্বলবেই। যুদ্ধের সময় জ্বলবে। স্বাধীন দেশেও জ্বলবে।
ওহ্, মামণি, আপনি—আপনি—
ছেলেরা কথা বলতে পারে না। ওদের সবার চোখ জলে ভরে যায়। বাইরে দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ স্তিমিত হতে থাকে। গাড়ির হর্ন শোনা যায়। মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সঙ্গে রিকশার টুনটুন শব্দ। মন্টুর মা টেবিল থেকে বাসন-কোসন সরাতে থাকে। ওরা সবাই এখন ড্রয়িংরুমে। মেরিনা সবার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। কথা শুরু করে মিজারুল।
আমরা ঠিক করেছি, মিন্টো রোড দিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে এগোতে থাকব। বড় নাগলিঙ্গমগাছটার নিচে প্রথমে গাড়ি থামবে। আমাদের দুজন সেখানে নামবে। ওরা ফুটপাত ধরে সামনে এগোবে। বাকিরা হোটেলের গেট থেকে একটু সামনে গিয়ে বড় গাছগুলো যেখানে আছে, সেখানে নামবে। তারপর ওরা দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকবে। সেখান থেকে মেইন গেটের কাছে গ্রেনেড ছুড়বে। হোটেলের পর্চে যদি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের গাড়ি থাকে, তবে সেই গাড়ির ওপরও গ্রেনেড ছোড়া হবে। যারা ফুটপাত ধরে এগোবে, তারা হোটেলের সামনের বারান্দার দুপাশে গ্রেনেড ছুড়বে। আমাদের গাড়ি থাকবে মিন্টো রোডে। কাজ শেষ করে আমরা গাড়িতে উঠব। গাড়ি মিন্টো রোড ছাড়িয়ে রমনা থানার পাশ দিয়ে মগবাজারে ঢুকবে। সেখানে মুসলিম লীগের নেতার বাড়িতে গ্রেনেড ছুড়ে আমরা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের দিকে যাব। ওই দুই অফিসে গ্রেনেড ছুড়ে আমরা পুরানা পল্টনের গলিতে ঢুকে গাড়ি ছেড়ে দেব। তারপর যে যার মতো নিরাপদ জায়গায় চলে যাব।
রুদ্ধশ্বাসে কথা শুনছিলেন আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন। কথা শেষ হলে আয়শা খাতুন তার ডান এবং বাম হাত মুঠি করে ধরে বলেন, এ বাড়িতে আসবে না তোমরা?
না, মামণি। আমরা এ বাড়িতে আসব না। এটা আমাদের যুদ্ধের কৌশল।
মারুফও সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমিও আসব না, মা। আমরা কে কোথায় যাব, সে বাড়িগুলো ঠিক করা আছে। ঢাকা শহরে এখন এমন অনেক বাড়ি আছে। তারা গেরিলাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে।
মেরিনা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, তাহলে তুমি কখন বাড়িতে আসবে, ভাইয়া?
যুদ্ধের সময় এমন প্রশ্ন করতে নেই, মেরিনা।
আকমল হোসেন চুপ করেই ছিলেন। অনেকক্ষণ পর বলেন, তোমাদের জন্য দোয়া করি। তোমাদের যাত্রা শুভ হোক।
আমিও তোমাদের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন। তোমরা যেন সবকিছু ঠিকমতো করে মায়েদের কোলে ফিরে আসতে পারো।
ওরা সবাই দুজনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলে দুজনে উঠে দাঁড়ান। শোবারঘরের দিকে যেতে যেতে আকমল হোসেন বলেন, তোমাদের সঙ্গে মেরিনা থাকবে। তোমাদের গ্রেনেড ও গুছিয়ে দেবে। এখন থেকে ও নিজেও তোমাদের গেরিলাবাহিনীর একজন। মনে রেখো, যুদ্ধ শুধু ছেলেদের নয়, যুদ্ধ মেয়েদেরও।
বাবার কথা শুনে মেরিনা উচ্ছ্বসিত স্বরে দুহাত ওপরে তুলে বলে, জয় বাংলা।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সূর্য পশ্চিম আকাশজুড়ে লাল আলো ছড়িয়েছে। পুরো ড়ুবে যায়নি। দুর্গবাড়ির তিনজন মানুষ ড্রয়িংরুমে চুপচাপ বসে আছে। টেলিভিশন ছাড়া। ভলিউম দেওয়া নেই বলে শব্দ হচ্ছে না। পর্দাজুড়ে নানা ছবি ভেসে উঠছে। গান হচ্ছে কিংবা অন্য কিছু। খবরের সময় হয়নি বলে টেলিভিশনে খবর নেই। কিছুক্ষণ পর মন্টুর মা এসে ড্রয়িংরুমে মেরিনার পাশে মেঝেতে বসে। মেরিনা জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?
ভয় করছে।
ভয়? কেন?
জানি না। ভয়ের কিছু নাই, খালা।
আছে। ওদের যদি কিছু হয়।
আপনি রান্নাঘরে যান। নইলে আপনার ঘরে যান। অজু করে জায়নামাজে বসেন। ওদের জন্য দোয়া করেন।
মন্টুর মা মাথা নেড়ে চলে যায়।