তিনি সাড়া দেন না। নিজেকেই বলেন, প্রতিদিন নতুন হওয়া সহজ কথা নয়। আমি কঠিনের সাধনা করছি। একাত্তর কঠিনের সাধনার সময়। এ সত্য তোমার চেয়ে কে বেশি বুঝবে! আমি তো জানি, গুনগুন করে গান গেয়ে তুমি নিজে কঠিনের সাধনা করো।
তিনি তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে শুরু করলে আয়শা খাতুন আবার দরজায় শব্দ করেন। তিনি এবারও সাড়া দেন না। ভাবেন, ওই শব্দ করে আয়শা খাতুন তার জন্য অপেক্ষা করুক। এরকম ভাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড ভালো লাগা তাকে আচ্ছন্ন করে। তিনি দ্রুত হাতে শরীর মুছে বেরিয়ে আসেন। দরজা খুললে দেখতে পান দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আয়শা খাতুন দাঁড়িয়ে আছেন।
এখনো দাঁড়িয়ে আছ?
তোমার জন্য, দেরি করলে যে?
ভীষণ খিদে পেয়েছে। টেবিল রেডি?
না, টেবিলে খাবার আনিনি। ছেলেরা দরজা বন্ধ করে মিটিং করছে। বলেছে, ওরা নিজেরা দরজা খুলবে; ওদের যেন ডাকাডাকি না করা হয়। মেরিনাও ওদের সঙ্গে আছে।
মিটিং করছে ওরা? ভুরু কোঁচকান আকমল হোসেন।
শুনলাম কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। গুলশান থেকে কোনো অবাঙালির গাড়ি হাইজ্যাক করবে। সেটা নিয়ে ওরা সন্ধ্যায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যাবে।
ও, আচ্ছা।
আকমল হোসেন ভেজা চুলে ঝাঁকি দেন।
তোমাকে খাবার দেব?
না, ওদের জন্য অপেক্ষা করি। একসঙ্গে খাব।
আকমল হোসেন শোবারঘরে ঢুকে মাথা আঁচড়ান। তারপর আলনা থেকে সাদা পাঞ্জাবি নিয়ে পরতে পরতে বলেন, আমি কি খুব বুড়ো হয়েছি, আশা?
এমন প্রশ্ন কেন করলে?
তোমার কথায় বুঝতে পেরেছি যে ওরা আমার গাড়িতে যাবে না।
তুমি নিজে নিজে ভেবো না। ওদের পরিকল্পনার কথা শোনো। ওদের হয়তো দুটো গাড়ি লাগতে পারে। কিংবা অপরিচিত কারও গাড়ি নিয়ে গেলে ওদের ধরা পড়ার ভয় কম থাকবে। পুলিশ সেই গাড়ি দেখে খুঁজতে শুরু করলে ওদের খুঁজে পাবে না।
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, আশা। ওরা গাড়িটা যেখানে-সেখানে ফেলে নিজেদের মতো করে ভিন্ন ভিন্ন পথে পালিয়ে যেতে পারবে। এটা ওদের যুদ্ধের কৌশল। ঠিকই ভাবছে ওরা।
তুমি বয়স নিয়ে মন খারাপ করলে।
আকমল হোসেন মৃদু হেসে বলেন, কী খাওয়াবে আমাদের?
এটা যুদ্ধের সময়। খাওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে না।
আয়শা খাতুন তর্জনী তুলে কথা বললে তিনি বুঝতে পারেন যে আয়শা তার কথা তাঁকেই ফেরত দিয়েছেন। তার পরও হেসে বলেন, যুদ্ধের সময় সব খাবারই অমৃত। রেডিওটা ছেড়ে দাও, আশা। দেখি, কোনো খবর আছে নাকি, যে খবর ছেলেদের কাজে লাগবে।
আয়শা খাতুন রেডিও ছেড়ে দেন। করাচি থেকে উর্দু ভাষায় পড়া খবর শোনা যায়। আকমল হোসেন ইজিচেয়ারে বসেন। আয়শা খাতুন ভেজা তোয়ালে নিয়ে বাইরে যান। বারান্দার রশিতে তোয়ালেটা ঝুলিয়ে দেওয়ার সময় টের পান ছেলেরা ঘরের দরজা খুলেছে। হুড়মুড় করে বের হচ্ছে ওরা।
মন্টুর মা কাছে এসে দাঁড়ায়।
লুচি ভাজা কি শুরু করব, খালাম্মা?
হ্যাঁ, করো। ওরা বের হয়েছে।
ছুটে আসে মেরিনা।
মা, টেবিলটা সাজাই।
হ্যাঁ, সাজাও, মা। দুপা এগিয়ে মেরিনা ফিরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ওরা আজকের অপারেশনের দারুণ পরিকল্পনা করেছে। আমি বলব না। ওদের কাছ থেকে শুনবে। আমি যাই।
আয়শা খাতুনের মনে হয়, এখনই একটা গান গাওয়ার সময়। কী গাইবেন? ধনধান্য পুষ্পভরা-
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি…
গানের ধ্বনি আর সুর ছড়ায় পুরো বাড়িতে। আকমল হোসেন কান খাড়া করেন। ছেলেরা যে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে একমুহূর্তে গানের বাণী নিজেদের বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়। বুঝতে পারে, তাদের জয় বাংলা মামণি তাদের কী মেসেজ দিচ্ছেন। মেরিনা গুনগুন ধ্বনি শুনে ভীষণ আপ্লুত হয়ে বলে, মায়েদের বুঝি এমনই হতে হয়। আয়শা খাতুন তখন রান্নাঘরে বিভিন্ন ডিশে খাবার সাজান। লুচি, আলুর দম, মুরগির রোস্ট, গরুর রেজালা। আর একটি বড় কেক। আজ ছেলেদের নতুন জন্মদিন। তাই সবাইকে দিয়ে কেক কাটাবেন তিনি। বলবেন, শুভ হোক তোমাদের যাত্রা। আমরা তোমাদের অপেক্ষায় থাকব।
খাবার টেবিল দেখে ছেলেদের চোখ ছানাবড়া।
মামণি, এত কিছু?
হ্যাঁ, এত কিছুই। বসে যাও। মন্টুর মা লুচি ভাজা শেষ করবে না। ওটা গরম গরম আসবে।
খাওয়া শুরুর মাঝামাঝি সময়ে আকমল হোসেন প্রশ্নটি ওঠান, তোমরা কখন বাড়ি থেকে বের হবে?
তিনটার দিকে।
প্রশ্নের উত্তর দেয় ওমর। একই সঙ্গে মিজারুল বলে, আমরা পরিকল্পনা বদলে ফেলেছি, খালুজান। আমরা ঠিক করেছি, আপনার গাড়ি আমাদের নেওয়া ঠিক হবে না। আমরা গাড়ি হাইজ্যাক করব।
এখান থেকে আমরা গুলশানে যাব। ওখানে রশীদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে গুলশান ১-এর শপিং সেন্টারের কাছে। হাইজ্যাক করবে রশীদ। তারপর গাড়িটি স্বপনকে দেওয়া হবে। ও চালিয়ে এই বাসায় আসবে। এখান থেকে গ্রেনেড নিয়ে আমরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যাব।
মিজারুল থামলে আকমল হোসেন বলেন, বেশ। তোমাদের পরিকল্পনা ঠিক আছে।
কায়েস বলে, যদি আমাদের অপারেশন সাকসেসফুল না হয়, যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, আমরা চাই না আর্মি আমাদের পিছু নিয়ে আমাদের এই দুর্গবাড়ি চিনে ফেলুক। তাহলে ভবিষ্যতের আরও নানা পরিকল্পনা আমাদের ভেস্তে যাবে।
ঠিক বলেছ। আমি তোমাদের সঙ্গে একমত। তবে আমার মনে হয়, তোমাদের সবার গুলশান যাওয়ার দরকার নেই। তোমরা তিনজন গুলশান যাও। বাকিরা এই বাড়িতে অপেক্ষা করো। গাড়ি নিয়ে এলে এরা উঠবে। এরা গ্রেনেড নিয়ে রেডি থাকবে।