তুই বাইরে গিয়ে দাঁড়া। দেখ, কী বলে।
বাকিরা চৌকি ছেড়ে উঠে পড়ে।
মারুফ বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওর চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান দেয়। একজন সৈনিক।
আর্মস-অ্যামুনিশন কিধার?
নেহি জানতা।
নেহি জানতা! গাদ্দার। বাতাইয়ে।
বাকিরা ঘরে ঢুকেছে। বিভিন্ন ঘর থেকে বের করে আনে সবাইকে। ওদের গেঞ্জি ও শার্ট খুলে হাত এবং চোখ বাঁধে। পাঁচ-ছয়বার বাড়ির চারদিকে ঘোরায়। ওরা কেউ কোনো কথা বলে না। রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাড়ি দিলে ওরা পাঁচজন শুধু বলে, নেহি জানতা। প্রশ্ন ছাড়া উত্তরটা অনবরত আওড়াতে থাকে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা।
ওদের কাছ থেকে অস্ত্রের খবর বের করা কি সহজ! ওরা তো মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে। ওদের হারানোর কিছু নেই।
যমদূতের মতো ছয়জন পাকিস্তানি সেনা ওদেরকে বাড়ির পেছনে নিয়ে যায়। গাছ, বুনো ঝোপ এবং ঘাস ও শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি চারদিকে কম্পন তোলে।
বাতায়ে মুকুত কিধার? বাতায়ে আর্মস কিধার?
ওরা বুক টান করে দাঁড়ালে গুলি বিদ্ধ হয় ওদের শরীরে।
মারুফের গুলি লাগে বুকে। বুক ফুটো করে বেরিয়ে যায়।
ময়েজের চোখে গুলি লেগে মাথার একাংশ উড়ে যায়।
স্বপনের পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসে।
মিজারুল আর ওমর আহত হয়। একজনের কানের পাশ দিয়ে গুলি চলে যায়। উড়ে যায় কান। অন্যজনের পায়ে লাগে।
লুটিয়ে পড়ে সবাই।
দুদিন পর ফার্মগেটের বাড়ির খবর নিতে আসেন আকমল হোসেন। সঙ্গে আলতাফ। দূর থেকে বাড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন অবস্থা খারাপ। আলতাফ পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে, স্যার, আপনি যাবেন না। আমি গিয়ে আগে দেখে আসি।
আকমল হোসেন মাথা নেড়ে সায় দেন।
বিধ্বস্ত বাড়িটির কাছে এসে আলতাফের বুক মুচড়ে ওঠে। বুঝতে পারে, এই বাড়িতে যুদ্ধ হয়েছে। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মনে হয়, বাড়িতে কেউ নাই। পাকিস্তানিরা বোধ হয় বাড়ি তছনছ করে চলে গেছে। বাড়ির ভেতরে ঢোকে না ও। একরকম ছুটে গিয়ে খবর দেয় আকমল হোসেনকে।
স্যার, যুদ্ধ। হাঁপাতে থাকে, যেন দম আটকে আসছে ওর। স্যার, চলেন।
তুমি কি ছেলেদের দেখেছ?
কাউকে দেখিনি, স্যার। আমি তো বাড়িতে ঢুকতে পারিনি। সব তছনছ হয়ে আছে। স্যার, অনেক বড় যুদ্ধ হয়েছে।
তুমি শান্ত হও, আলতাফ। তোমাকে উত্তেজিত দেখলে মিলিটারি পুলিশ সন্দেহ করবে। তুমি গাড়িতে ওঠো। গাড়িটা অন্যদিকে কোথাও রেখে আসি।
আকমল হোসেন বিপন্ন বোধ করেন। আলতাফকে তা বুঝতে দেন না। গাড়ি গ্রিন রোড ধরে অনেকখানি চালিয়ে ফিরে আসতে থাকেন। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। দেখতে পান, আলতাফ দুহাতে চোখ মুছছে। নিজেরও একটু খটকা আছে। অপারেশনের পর মারুফ বাড়িতে ফোন করেনি। তাহলে কি ও রূপগঞ্জে চলে গেছে। না মেলাঘরে? বুক চেপে আসে। তার পরও মাথা ঠিক রেখে বাড়ির কাছাকাছি এক জায়গায় গাড়ি পার্ক করেন।
তুমি গাড়িতে থাকো, আলতাফ।
না, স্যার, আমিও আপনার সঙ্গে যাব। গাড়ি এখানে থাকুক। যা হয় হবে। তিনি এক পলক দীর্ঘদিনের পারিবারিকভাবে যুক্ত লোকটির দিকে তাকান। শুকনো, ছোটখাটো মানুষটি। বছর দশেক ধরে তাঁর কাছে আছে। পরিবারের সুখ-দুঃখের সঙ্গে এক হয়ে আছে। আজও তার ভূমিকা পরিবারের একজনের মতোই। তিনি আলতাফের হাত ধরে বলেন, আমার পা টলছে। ঠিকমতো হাঁটতে পারছি না।
সে জন্যই আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি। আমি তো জানি, এই দুর্গবাড়িটি আপনি খুব যত্ন করতেন। এখানে এলে আপনি যুদ্ধ আর শান্তি দেখতেন। আপনি আমাকে এ কথা বলেছেন।
দুজনে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান। আকমল হোসেন আলতাফের হাত চেপে ধরে বলেন, একি! আশ্চর্য! এতটা ঘটেছে। কেউ আমাকে কোনো খবর দিল না। হায় আল্লাহ, ওরা কোথায়?
বাড়ির সামনের প্রাঙ্গণ, প্রতিটি ঘর তছনছ, লন্ডভন্ড। আক্রোশ মেটানো যে হয়েছে তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। কোথায় গেল ছেলেরা? সরে পড়তে পেরেছিল কি?
আর কোথায় খুঁজব? তার চেয়ে বাড়িতে গিয়ে অন্য দুর্গবাড়িতে ফোনে যোগাযোগ করে দেখি কোনো খবর পাওয়া যায় কি না।
স্যার, বাড়ির পেছন দিকটা দেখে আসি।
পেছনে তো সব বুনোনা ঝোপঝাড়। ও ব্যাটারা এরকম জায়গায় যেতে ভয় পায়।
স্যার, আমাদের এখানে আসা আর না-ও হতে পারে। দেখে আসি। খোঁজ নিতে তো অসুবিধা নাই।
ঠিক আছে, চলো, আমিও যাই। তুমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ, আলতাফ।
আকমল হোসেন বাড়ির পশ্চিম দিক ঘোরেন প্রথমে। ওখানে ঝোপঝাড় পায়ের নিচে দোমড়ানো। মনে হয় অনেকগুলো বুটের নিচে থেঁতলে গেছে ঘাস। তার শরীর শিউরে ওঠে। তাহলে যুদ্ধ কি বাড়ির পেছনে হয়েছে? তিনি পশ্চিম থেকে দক্ষিণে আসেন। দূর থেকেই দেখলেন, পাঁচটি রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। ছুটে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই চক্ষু স্থির হয়ে যায় আকমল হোসেনের। ওদের চোখ এবং হাত বাঁধা। মারুফ চিত হয়ে পড়ে আছে। বুকজুড়ে ফোকর তৈরি হয়েছে। ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে চারদিক। আকমল হোসেন হাঁটু গেড়ে বসলেন। বুকের ফুটোর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দুহাত বাড়িয়ে মিজারুলের বাম পায়ের পাতা পেলেন। আর স্বপনের ডান হাত। মাথা ঝুঁকে গেল তার বুকের ওপর।
কতক্ষণ সময় গেল দুজনের কেউই বুঝতে পারেন না। আকমল হোসেন অনুভব করেন, তার মাথা ক্রমাগত শহীদের শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়ছে। তিনি মাথা কাত করে আলতাফকে বলেন, বাসায় যাও।
আলতাফ আঁতকে উঠে বলে, বাসায়!
হ্যাঁ, বাসায়। তোমার খালাম্মা আর মন্টুর মাকে নিয়ে এসো।