আবারও তোমাদের কনগ্রাচুলেশনস। ওরা বুঝেছে যে আমাদের দমাতে পারেনি।
আঙ্কেল, দোয়া করবেন।
সেদিন তিনি নিজের টেবিলে এসে বসলেন। ডায়েরির পাতা খুললেন। আয়শা উল-কাটা নিয়ে সোয়েটার বুননের বাকি কাজ নিয়ে বসেন। পেছনের বারান্দার দিক থেকে ঝিঁঝিটের ডাক ভেসে আসে। দুজনেরই মারুফের কথা মনে হয়। শব্দের ভেতরে স্মৃতির বিকাশ ঘটে। শব্দ স্মৃতিকে পথে ডাকে। দুজনেই ভাবলেন, পথের ডাকে স্মৃতির রেশ বড় নিষ্ঠুর। দুজনে ঘুমোত গেলে পরস্পরের দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে থাকলেন। বুঝলেন, জীবনের জলরঙে স্মৃতির ক্যানভাস ভরে না। কোথায় পালাবেন তারা? তাদের সামনে কোনো ঠিকানা নাই। যন্ত্রণার দাবদাহে পুড়বেন। আবার ফিনিক্স হয়ে জাগবেন। জাগতেই তো হয় মানুষকে। তারা পরস্পরের দিকে মুখ ফেরালেন। হাত ধরলেন। আয়শা খাতুন বিড়বিড় করলেন, মারুফ যে এখন কোথায় আছে? শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে? নাকি সীমান্তের ওপারে? আকমল হোসেন বিড়বিড় করলেন, আমরা কেন ওর কথা ভাবছি। ওকে তো ওর মতো থাকতে দিতে হবে। আয়শা বললেন, তাহলে কি অপেক্ষা করব? হ্যাঁ, অপেক্ষাই করতে হবে আমাদের। ওর বিজয়ী হয়ে ফিরে আসার অপেক্ষা।
দুজনেরই মনে হয়, চারদিক তোলপাড় হচ্ছে। ঝিঁঝিটের ডাক নেই। পোকাগুলোকে বুটের নিচে পিষে মারছে সৈনিকেরা। ওরাও এখন ওদের শত্রু। ওই শব্দ যেন কারও স্বাধীনতার স্বপ্ন বাড়িয়ে না দেয়, সে জন্য ওদের এমন নিধন। দুজনে বিছানার ওপর উঠে বসেন।
তুমি কি কোনো স্বপ্ন দেখেছ, আশা?
আমার মনে হচ্ছিল, মারুফ বুঝি ডাকছে। ও পাগলের মতো আমাদের খুঁজছে। আমরা সামনে দাঁড়িয়ে আছি, ও আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। তুমি কিছু স্বপ্ন দেখেছ?
আমার মনে হলো, মারুফ আমাদের দেখে হেঁটে আসছে। কিন্তু ভীষণ কুয়াশা ওর চারদিকে। কুয়াশা কখনো নীল, কখনো সাদা। কখনো গোলাপি, কখনো সবুজ। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আমি ওকে এভাবেই দেখব অনন্তকাল।
আমাদের মাথা কি খারাপ হয়ে যাচ্ছে?
নাকি আমরা ওকে দেখার জন্য ব্যাকুলতা বোধ করছি?
দুজনের প্রবল নিঃশ্বাস বাতাসে উড়ে যায়। দুজন পেছনের বারান্দায় এসে বসেন। সুনসান রাত। কুকুরও কোথাও ডাকছে না। পাখিও না। জোনাকি নেই। অন্ধকার সামনে রেখে বসে থাকার যন্ত্রণা দুজনকে কুঁকড়ে রাখে।
পরদিন মারুফের ফোন আসে। ফোন ধরেন আয়শা।
আম্মা, আমি ঢাকায় এসেছি।
কোথায় আছিস, বাবা?
ফার্মগেটের দুর্গবাড়িতে।
বাড়িতে আসবি একবার?
অপারেশনের পরে আসব। আব্বা কই?
তিনি তো বাইরে গেছেন। ডা. আশরাফের সঙ্গে একজন আহত গেরিলাকে দেখতে যাবেন।
কে আহত হয়েছে, আম্মা?
নাম তো আমার মনে নাই রে।
আব্বার সঙ্গে আর কথা হবে না। আব্বাকে আমার সালাম দেবেন।
ছেলের সঙ্গে কথা বলে আয়শার মন খুশিতে ভরে যায়। ভাবেন, আলতাফকে বাজারে পাঠাবেন। মারুফের পছন্দের খাবার ফ্রিজে রাখতে হবে। তিনি রান্নাঘরে আসেন।
মন্টুর মা, মারুফ ঢাকায় এসেছে।
মেলা অস্ত্রশস্ত্র এনেছে?
এনেছে বোধ হয়।
কোথায় যুদ্ধ করবে?
এটা তো আমাকে বলেনি। এসব কথা ফোনে বলা ঠিক নয়।
হ্যাঁ, তাইতো। কী রাঁধব আজ?
ওর পছন্দের সবকিছু। আলতাফ যা আনবে, সব দেখেশুনে রান্না করবে। ফ্রিজে রাখা হবে। ও কখন আসে বলা তো যায় না।
মন্টুর মা ঘাড় নেড়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করার কাজে লেগে যায়। আয়শা খাতুন মারুফের তছনছ করে যাওয়া ঘরটা গোছাতে শুরু করেন। জোরে জোরে সেনাসদস্যদের গাল দেন, বকা দেন। মানুষের ঘরদুয়োর নষ্ট করার জন্য অভিশাপ দেন। আয়শা খাতুনের মনে হয়, তিনি জীবনের বাকি সময়ে এই ঘর আর ঠিক করতে পারবেন না। এ বড় কঠিন কাজ।
আকমল হোসেন বাড়ি ফিরে দেখতে পান, আয়শা খাতুন ঘর পরিষ্কার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে খাটের পাশে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। তিনি জেনেছেন মারুফের টেলিফোনের কথা। তার সঙ্গে ছেলের কথা হলো না! এই বিষাদে তিনি খানিকটা মনমরা হয়ে গেলেও ছেলের ঘর দেখে স্বস্তি পেলেন। এত দিন কোনো ঘরই গোছানো হয়নি। আজ মারুফের ঘর গোছানো হচ্ছে। বুকের ভেতরে খানিকটা স্বস্তি ফিরিয়ে এনে ভাবলেন, আয়শা ঘুমাক। ওর ঘুম খুব দরকার। ও নিজের সঙ্গে লড়াই করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তার আর নিজের ঘরে যাওয়া হলো না। মারুফের ঘরে ঢুকে খালি একটা চেয়ারে বসে পড়েন।
পরদিন সকালে ফার্মগেটের দুর্গবাড়ি আক্রমণ করে আর্মি। বেশ কিছুদিন ধরে এলাকার চারদিকে নজর রাখছিল ওরা। নতুন লোকজনের আসা-যাওয়া খেয়াল করছিল। কে কোন দিক থেকে আসছে, কোন দিকে ঢুকছে এই সব। নতুন লোক দেখলে মাঝেমধ্যে আইল্যান্ডে অবস্থানকারী মিলিটারি পুলিশ জিজ্ঞেস করত, তুমহারা নাম কেয়া? কিধার যায়েগা? উত্তর না দিলে বেতের লাঠির খোঁচা দিয়ে বলত, বাতাইয়ে।
এই উৎপাতের কারণে এলাকায় পায়ে হাঁটা লোকজনের চলাচল কমে গিয়েছিল। তারপর গোয়েন্দারা গেরিলাদের আশ্রয়কেন্দ্রটি খুঁজে পায়। তখন সকাল আটটা বাজে। ওরা পাঁচজন ছিল বাড়িতে। কেউ ঘুম থেকে জেগেছে, কেউ বিছানা ছাড়েনি। এমন সময় যমদূতের মতো এসে দাঁড়ায় ওরা। ওদের আগমনের খবর প্রথমে টের পায় মারুফ। ঘরে ঢুকে অন্যদের খবর দেয়, আমাদের দুর্গ আক্রান্ত হয়েছে। ওরা বাড়ির উঠোনে এসেছে। ওরা ছয়জন। রাইফেল, স্টেনগান আছে হাতে। গাছপালাঘেরা বাড়ি তো, তাই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সতর্কতার সঙ্গে আসছে।