আর কয়েক ঘণ্টা পর সূচিত হবে একটি মাহেন্দ্রক্ষণ।
গাড়ি এসে থামে বাড়ির সামনে। গাড়ির পাশাপাশি দৌড়ে এসে আলতাফ গ্যারেজ খুলে দেয়। গ্যারেজে ঢোকানোর আগে গাড়ি থামান আকমল হোসেন। ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের বলেন, নামো।
ওরা এক লাফে নেমে দুই লাফে বারান্দায় ওঠে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল মেরিনা। হেসে বলে, সবাইকে বেশ উফুল্ল দেখাচ্ছে। বলব কি, ব্রাভো, গেরিলা ফাইটার।
মিজারুল থমকে দাঁড়িয়ে বলে, বলতে পারো। আস্তে করে বলো। তোমার গলা যেন রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে না যায়।
এই সাহস হারালে চলবে কেন? চেঁচাব এখনই।
পেছনে বাবা আছে। অকারণে ধমক খেয়ো না।
আচ্ছা, ঠিক আছে। টেবিলে লেবুর শরবত বানানো আছে। যে যার মতো খেয়ে ফেলেন।
দুপুরে কী?
মা আপনাদের সারপ্রাইজ দেবেন।
তাহলে চেঁচিয়ে বলি, জয় বাংলা, মামণি।
ছেলেরা ঢুকতে ঢুকতে বলতে থাকে, জয় বাংলা। দুর্গবাড়ি অমর হোক। বারান্দায় উঠে আসেন আকমল হোসেন। প্রবল ঘামে মুখ ভিজে আছে। গ্যারেজে আলতাফ বলেছিল, স্যার পানি খাবেন, তিনি না করেছিলেন। অনেক ঘেমে গেছেন স্যার, আলতাফের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল। তিনি বলেছিলেন, কী রকম গরম পড়েছে দেখেছ? একদম কাঠফাটা রোদ আরকি। আলতাফ হোসেনের তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, আপনার অনেক ধকল গেছে কি, স্যার? তিনি মৃদু হেসে বলেছিলেন, যুদ্ধে জড়ালে কোনো কাজকে ধকল বলতে হয় না, আলতাফ। কথাটা শুনে আলতাফ লজ্জা পেয়ে বলেছিল, আমি ভুল করেছি। আমার বলা উচিত ছিল জয় বাংলার সময় সব কাজই জয় বাংলা, স্যার।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
এটুকু বলে আকমল হোসেন বারান্দায় উঠেছিলেন। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল মেরিনা। বাবার ঘর্মাক্ত মুখ দেখে দ্রুতকণ্ঠে বলে, শরবত দেব, আব্বা?
কথা বলিস না। তোর মা কই?
গোসল করছেন।
ভালো হয়েছে। এক গ্লাস শরবত খেয়ে আমি বাথরুমে ঢুকব।
আপনাকে কখনো এত ঘামতে দেখিনি, আব্বা।
তোর মা দেখেছে। সে জন্য তোর মাকে আমার ঘামঝরা মুখ দেখাতে চাই না।
যা গরম পড়েছে! আপনি তো ঘামতেই পারেন।
সে তো ঘামতেই পারি। যুদ্ধের সময় না হলে এই ঘামভরা মুখ দেখলে তোর মা আমাকে বাথরুমে পাঠিয়ে দিত। কিন্তু এখন দেবে না। অন্য কথা বলবে।
কী কথা, আব্বা? আপনার কথা শুনে আমি খুব অবাক হচ্ছি।
এখন আমাকে দেখলে তোর মা বলবে, তোমার আর ওদের সঙ্গে যেতে হবে না। তুমি এই বাড়ির অস্ত্রগুলো পাহারা দাও। তোর মা তো বলে আমাকে দুর্গের পাহারাদারই বেশি মানায়। সব কথা তো আর তোদের সামনে হয় না। রাতে ঘুমানোর সময় অনেক কথা হয়।
বোধ হয় ঠিকই বলেন, আব্বা।
তুই তোর মায়ের পক্ষে গেলি!
পক্ষে-বিপক্ষে না, আব্বা, মায়ের কথাটা আমার ঠিক মনে হয়েছে।
আকমল হোসেন মেয়ের কথায় সায় দেন না। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে দুগ্লাস শরবত খান।
আব্বা, আপনি কি মন খারাপ করলেন?
মন খারাপ নয়। কথাটা ভেবে দেখার মতো। যাকে যেভাবে কাজে লাগানো যাবে, সেটাই হবে যুদ্ধের সময়ের স্ট্র্যাটেজি। দেখলি না, রোদে ঘোরাঘুরি করেও ছেলেরা কিন্তু ঘামেনি। ওরা ঠিকই আছে। ওরা তো কেউ শরবতও খায়নি দেখছি।
আমি ট্রে ভরে গ্লাসগুলো ভাইয়ার ঘরে দিয়ে আসব।
হ্যাঁ, তা-ই কর। সন্ধ্যার আগেই ওদের আবার বের হতে হবে।
আকমল হোসেন নিজের ঘরে যেতে যেতে দেখতে পান আয়শা খাতুন। গোসল করে বেরিয়েছেন। হাতে একগাদা ভেজা কাপড়। মন্টুর মাকে ডেকে কাপড়গুলো রোদে শুকানোর জন্য দেন। তারপর ঘরে ফিরে আসেন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলেন, কেমন হলো তোমাদের?
ভালোই হয়েছে। এখন সন্ধ্যার অপেক্ষায় আছি।
গোসলটা সেরে নাও। তোমার গোসল হলে টেবিলে খাবার দেব।
আকমল হোসেন তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়েন। স্বস্তি পান এই ভেবে যে আয়শা খাতুন তার ঘর্মাক্ত মুখ খেয়াল করেননি। অবশ্য শরবত খাওয়ার সময় তিনি নিজেও হাত দিয়ে মুখ মুছেছেন। আলতাফ ও মেরিনা যতটুকু দেখেছে, অতটুকু দেখার সুযোগ আয়শা খাতুনের ছিল না। বাথরুমে ঢুকে আকমল হোসেন প্রবল স্বস্তিতে গায়ে পানি ঢালেন। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার সময় তার মনে হয়, পানি তাঁর শরীরে নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে। তখন তাঁর পুরোনো কথা মনে হয়—স্মৃতির নদীতে পুরোনো কথা স্রোতের মতো বয়। নইলে যৌবনের সময়ের কথা এখনকার সময়ে বয়ে এল কী করে! পাঠশালার শিক্ষক প্রতিদিন নদীর ঘাটে স্নান করতে আসতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে কাছে দাঁড় করিয়ে বলতেন, মনে রাখিস, যে নদীতে তুই বারবার নামিস, সে নদী কখনো এক রকম থাকে না। নদীর জল নতুন স্রোত তৈরি করে। নদী নতুন হয়।
তাহলে তো, দাদু, আমিও এক রকম ছেলে থাকি না। আমিও নদীর মতো প্রতিদিন নতুন ছেলে হই। না দাদু?
ঠিক ধরেছিস। এ জন্যই তো তুই ক্লাসে ফার্স্ট হোস। ভগবান তোর মগজভরা মেধা দিয়েছেন। তোকে আশীর্বাদ করি রে, দাদু।
নতুন ছেলে, নতুন ছেলে বলতে বলতে নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি। এখন মনে হয়, সেদিন এক আশ্চর্য সময় ছিল তার জীবনে। সময়কে, জীবনকে বুঝে ওঠার সময়। বুঝেছেন সব চোখ খোলা রেখে, করোটিতে সাদা আলো জ্বালিয়ে রেখে। সেই বোঝা ফুরোয়নি তার জীবন থেকে। এখন আবার নতুন সময় এসেছে নতুনের হয়ে ওঠার সাদা আলোয় নিজেকে চেনার। ভাবতে ভাবতে হাত বাড়িয়ে শাওয়ারের ট্যাপ বন্ধ করেন। শুনতে পান, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আয়শা খাতুন বলছেন, কী হলো, আজ এত সময় লাগছে কেন তোমার? গায়ে এত পানি ঢাললে ঠান্ডা লাগবে।