দাঁড়াও, শাড়িটাকে ঠিক করে নিই।
এখন চলে আসুন, ওপারে গিয়ে করবেন। সাপ-খোপের জায়গা।
ওপারে এসে বিলকিস হাঁপাতে থাকে।
একটু দাঁড়িয়ে যাবেন?
না, না।
একটা জায়গায় জন্ম নিলেই কি তার প্রতিটি ধূলিকণা, গাছ, আকাশ, চাঁদ, বাড়ি চেনা হয়ে যায়? কাছারি পাড়ার পেছনে যে এত ঘন বন, আগে কখনো জানা ছিল না বিলকিসের। পাড়ার সড়ক দিয়ে যাতায়াত করছে। পেছন থেকে এখন পাড়াটিকে সম্পূর্ণ নতুন আর অচেনা মনে হয়।
ঠিক বন নয়। অসংখ্য আম, লিচু, জামের গাছ। বকশি বাবুদের বাগান বাড়ি ছিল।
বকশি বাবুদের বাগানে রাস্তা ভালো, আপা। শুধু খেয়াল রাখবেন, অনেক শুকনো পাতা তো, শব্দ না হয়। এখান থেকে সোজা শর্টকাট করে পোস্টাপিসের পেছনে গিয়ে পড়ব। তারপর বাজারের রাস্তা। আগে পোস্টাপিস পর্যন্ত যাই তো।
যে সিরাজ আলেফ মোক্তারের বাসায় ইতস্তত করছিল, আপত্তি করছিল, সেই সিরাজই এখন হাল হাতে নিয়েছে।
চাঁদের আলোয় বিচিত্র হয়ে উঠেছে বনের তলদেশ।
বিলকিস বলে, তুমি তো বললে না, ওদের এত রাগ কেন খোকার ওপর?
খোকা ভাইয়ের খুব ভালো গলা ছিল গানের।
রংপুর রেডিও থেকে দুদিন গান করেছিল। ঢাকায় আমার কাছে আসতে চেয়েছিল। ঢাকা রেডিও থেকে গান গাইবার খুব শখ ছিল। তুমি চিনতে খোকাকে?
চিনতাম। আলাপ ছিল না আপা।
কেন খোকার লাশের ওপর ওরা ওরকম করল?
বোধহয়, গান গাইত, খোকা ভাই এখানে সবাইকে আমার সোনার বাংলা শিখিয়েছিল। মার্চ মাসের মিছিলগুলোতে খোকা ভাই সবার আগে থাকত, একেকটা মোড়ে দাঁড়িয়ে সকলে আমার সোনার বাংলা গাইত। সবার চোখে পড়ে গিয়েছিল খোকা ভাই। কেন পালিয়ে যায় নি?
সকলে তো পারে না। আমিও পারি নি।
মা বুড়ো মানুষ। বোধহয় তাই যায় নি।
খোকা ভাই কিন্তু মোটেই পথে বেরুত না। কী করে যে ধরা পড়ল?
বাড়ি থেকে?
না। মকবুলদা বলল, ছেলেরা যখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে সরে যেতে বলে, খোকা ভাই তখন বাড়িতে ছিল না।
কোথায় গিয়েছিল তবে?
নীরবে দুজনে বাগানটা পেরোয়। প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ফাঁকে ফাঁকে এখনই দেখা যাচ্ছে পোস্টাপিসের হলুদ দালান। দালানের পাশ ঘিরে ছোট একটা বাঁশবন। পতাকাশূন্য দণ্ডের মতো খোলা আকাশে স্থির হয়ে আছে।
০৮. লাশ আর লাশ
তারপর সেই দৃশ্য দেখা যায়। বাজারের খোলা চত্বরময় ছড়িয়ে আছে লাশ! বেড়াহীন উলঙ্গ দোকানের খুঁটি আঁকড়ে পড়ে আছে লাশ। আলোর দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে যে গলিটা, তার ওপরে উপুড় হয়ে আছে লাশ। লাশের পর লাশ। এক, দু, তিন, চার, ছয় সারি চোখে পড়ে–বাজারে হয়তো ফল বেচাতে এসেছিল গাছের, দুটো বাচ্চা উল্টে থাকা গরুর গাড়ির ছাউনি জড়িয়ে ধরে–লাশ; সমস্ত চত্বর আর খালের ঢালু জুড়ে ইতস্তত বাঁশের গোল গোল ঝাকা, কলস, সবজি; আর সমস্ত কিছুর ওপরে স্তব্ধতা, স্থিরতা, প্রত্যাবর্তনের আশাহীন অক্ষমতা।
মৃত্যুর মতো স্পন্দনহীন হয়ে যায় দুজন। বাস্তবের অতীত অথচ সত্যের সীমানার অন্তর্গত দৃশ্যটির দিকে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে বিলকিস আর সিরাজ।
তারপর, দুজনেই একসঙ্গে, রক্তের ভেতরে অভিন্ন বোধ প্রবাহ নিয়ে একে অপরের দিকে তাকায়। ক্ষণকাল পরে সিরাজ হঠাৎ মুখ ঢাকে দুহাতে। টিনের বেড়ার ওপর মাথা ঠেকিয়ে নিশ্চল হয়ে যায়।
বিলকিস আবার ফিরে তাকায় চাঁদের মেঘাক্রান্ত আলোয় উদঘাটিত চত্বরের দিকে। খোকার মুখে প্রস্রাব করে দেবার কথা শোনার মুহূর্ত থেকে যে ক্ৰোধ তার ভেতরে তলোয়ারের মতো খাড়া হয়ে ছিল, এখন তা ঝলসে ওঠে। তার দ্যুতিতে ম্লান হয়ে যায় সব কিছু। লাশগুলো ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না তার। সে সমুখের দিকে পা ফেলে।
ছায়ার মতো কী একটা অপসৃত হয়!
বিলকিসের চেতনায় সেই ছায়া কোনো রেখাপাত করে না।
কিছুটা দূরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা লাশের দিকে স্থির চোখ রেখে সে এগোয়। অচিরে সে পাট গুদামের ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে; আসে খোলা আলোর নিচে, অস্পষ্ট তার ছায়া তাকে অনুসরণ করে; সে এগিয়ে যায়।
বিস্ফারিত চোখে সিরাজ তাকিয়ে দ্যাখে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সে। তার মনে হয়, ঘুমন্ত অনেকগুলো মানুষ, তার ভেতরে প্রেতের মতো হেঁটে চলেছে এক রমণী; সেই রমণীকে বর্তমানের মনে হয় না, অতীতেরও নয়, কিংবা কোনো আগামীর। স্তম্ভিত সময়ের করতলে ক্ষণকাল ছবিটি উদ্ভাসিত থেকে নাতিধীর গতিতে মলিন হয়ে যায়।
সিরাজ তাকিয়ে দ্যাখে, এক খণ্ড ধূসর মেঘ চাঁদটাকে ঢেকে দিয়েছে। ধূসর সেই মেঘের পেছনে অতি দ্রুত গতিতে আরো অনচ্ছ আরো ধূসর মেঘ ছুটে আসে এবং চাঁদটাকে গ্রাস করে ফেলে।
সম্মুখে তাকিয়ে দ্যাখে, বিলকিসকে আর দেখা যায় না।
লাশগুলোকে খণ্ডিত কিছু অন্ধকার বলে বোধ হয়।
চত্বরে দৌড়ে যায় সে। প্রথমে খুঁজে পায় না বিলকিসকে। যেন এই বাস্তবতাকে নিঃশব্দে গ্রাস করে ফেলেছে অথবা মৃতেরা তাকে দলে টেনে নিয়েছে।
পায়ের কাছে নরম একটা কিছুতে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় সিরাজ। দ্যাখে, বিলকিস মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে একটি লাশের মুখ উপুড় হয়ে দেখছে।
মধ্যবয়সী কৃষকের চোখ দুটি বিস্ফারিত, ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছিল, জমাট বেঁধে আছে; দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে একটু, যেন সাক্ষাতে সাড়া দিয়ে মৃদু হাসছে।
বিলকিসকে টেনে তোলে সিরাজ–আপা।
বিলকিস স্থির কণ্ঠে বলে, এত লাশ, সিরাজ!
চারদিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিপাত করে সিরাজ হাত ধরে টান দেয়–এদিকে আসুন।
একটা চালার আড়ালে তাকে টেনে এনে সিরাজ তিরস্কার করে। আপনার কি মাথা খারাপ? কে কোথায় আছে না আছে।