- বইয়ের নামঃ রক্তগোলাপ
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. বছরের এ সময়ে বৃষ্টি
বছরের এ সময়ে বৃষ্টি হয় কেউ কখনো শোনেনি। এ হচ্ছে এমন একটা সময়, যখন আকাশটা প্রজাপতির পাখার মতো ফিনফিন করতে থাকে রোদ্দুরে, নীল রঙে; যখন উত্তর থেকে নতুন প্রেমের মতো গা–শির–শির–করা মিষ্টি বাতাস বয় কী বয় না তা বোঝাও যায় না; যখন লোকেরা খুব স্ফুর্তির মেজাজে থাকে আর বলাবলি করে সংসারে বেঁচে থাকাটা কিছু মন্দ নয়; আর ছেলেমেয়েরা কাঁচের জিনিসপত্তর ভাঙলেও যখন মায়েরা কিছু বলে না; যখন হাট বসতে থাকে বিকেলের অনেক আগে থেকেই আর ভাঙতে ভাঙতে অনেক রাত্তির হয়ে যায়, কারণ বছরের এ রকম সময়ে অনেক রাত্তিরেও মানুষ একা হয়ে যায় না, ভয়। করে না, নদীর খেয়া বন্ধ হয় না। এ রকম দিনে বৃষ্টি হয় বলে কেউ কখনো শোনেনি।
কিন্তু আজ কোথা থেকে একখণ্ড কালো মেঘ এসে জমেছিল, ট্রেজারির পেটা ঘড়িতে চারটে বাজবার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বাতাস দিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের। রাস্তার ওপর সবে আধখানা হাট বসেছিল, সবে গিন্নীরা পয়সা বার করে দিচ্ছিল কর্তাদের হাতে, সবে তেলেভাজাওলা তার উনুন জ্বালিয়েছিল, এমন সময় বৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে দুহাত দূরেও কিছু আর দেখা গেল না। কেউ আর বাইরে রইল না। ডাকাত পড়ার মতো একটা শোরগোল পড়ে গেল; যে যেমন পারল রাস্তার দুপাশে জুতো কাপড় ট্রাঙ্কের দোকানের বারান্দায় ভিজতে ভিজতে এসে দাঁড়াল। এমনকি মসজিদের ভেতরটাও লোকে আর তাদের কাপড় থেকে চুঁইয়ে পড়া পানিতে গমগম সপসপ করতে লাগল; মন খারাপ করে নিমিলিত নেত্রে বসে রইলেন ইমাম সাহেব; আলু পটল কুমড়োর বড় বড় ঝাঁকাগুলো পথের ওপরেই ভিজতে লাগল। একটা খেয়া এপারে এসেছিল বৃষ্টি মাথায় করে কিন্তু আর ফিরে যেতে পারল না। ক্যাশবাক্স গামছা দিয়ে ঢেকে ভিজতে লাগল ঘাটিয়াল। যাকে তাকে খামোকা গালাগাল দিতে লাগল সে। ওপারে ধু ধু পাড়ের ওপর কয়েকজন হাটুরে হতভম্ভ হয়ে কোথায় পালাবে বুঝতে না পেরে যে যেদিকে পারল দৌডুল।
সে বৃষ্টি আর থামল না।
এক সময় বাতাসের এক প্রচণ্ড নিঃশ্বাসে মড়মড় করে ভেঙে পড়ল টাউন হলের মাথা থেকে কাঠের ফ্রেমে চটের ওপর সাটা বিরাট প্ল্যাকার্ডখানা। তাতে লেখা ছিল—
হৈহৈ কাণ্ড, রৈরৈ ব্যাপার, সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাইবেন না। আর্টিস্টকুলের যুবরাজ মায়াশক্তিসম্পন্ন প্রফেসর নাজিম পাশার অদ্ভুত ইন্দ্রজাল। সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টিকারি যাদুকরের শেষ প্রদর্শনী।
রূপসী মিস চম্পার অপূর্ব ক্রীড়া চাতুর্য।
নয়ন-মন সার্থক করুন।
আসুন, আসুন, আসুন।
প্ল্যাকার্ডের এক কোণে চিত্র ছিল প্রফেসর নাজিম পাশার হাসি ভরা পাগড়ি বাঁধা চেহারার। তার নিচে দুখানা হাড় ক্রশ করে রাখা। আরেকদিকে, একটা মেয়েকে গলা থেকে হাঁটু অবধি বাসে বন্ধ করে করাত দিয়ে দুখানা করা হচ্ছে, রক্ত পড়ছে। একেবারে নিচে আঁকা, কালো বোর্ডে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো একটা মেয়ে, তাকে, ছোরা তুলে তাক করে আরেকজন। বসে বসে পোষা পায়রাগুলোকে দানা খাওয়াচ্ছিলেন নাজিম পাশা, এমন সময় প্ল্যাকার্ড ভেঙে পড়ল। হাতের বাটি সরিয়ে রেখে চিৎকার করে উঠলেন তিনি– চম্পা, চম্পা।
টাউন হলের পেছনেই লাগোয়া দুটো ছোট কামরা আ সাজঘর। কামরা দুটোয় শহরের কর্তারা প্রাইভেট মিটিং করেন। আর সাজঘরটা কালে–ভদ্রে নাটক হলে ধুলো ঝেড়ে চামচিকে তাড়িয়ে ব্যবহার করা হয়। সাজঘরে বসে প্রফেসরের কোটের আস্তিনে লুকোনো পকেট নতুন করে টাকছিল চম্পা। কাল রাত্তিরের শো–এ বড় সাকরেদ জহির উইংসের আড়াল থেকে কালো সুতো–যেটা বাধা ছিল আস্তিনের এই গোপন পকেটে লাল রুমালের সঙ্গে—-টানতে গিয়ে মটমট করে সেলাই শুদ্ধ খসিয়ে এনেছিল; আরেকটু হলেই দর্শকের সামনে ফাস হয়ে যেতো জারিজুরি, ভাগ্যিস প্রফেসর টের পেয়ে তখনই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। চম্প সেলাই করতে করতে প্রথমে শুনল প্ল্যাকার্ড ভেঙে পড়বার শব্দ, পরক্ষণেই প্রফেসরের ডাক–চম্পা, চম্পা।
নিঃশব্দে এ ঘরে এসে চম্পা দেখল, প্রফেসর নাজিম পাশা দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছেন—-কিন্তু বাতাসের, বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। পায়রাগুলো তার পায়ের কাছে ঘুরছে।
চম্পা অবাক হল না। একটু বিরক্ত হল।
বাবা যখন কাঁদেন, কোন শব্দ কবেন না, মনে মনে ভাবল সে। কেবল গোলগাল মোটা। শরীরটা একটু একটু কাঁপতে থাকে আর লাল হয়ে ওঠে চোখ, যেমন এখন কাঁপছে। তাকে কাঁদতে দেখে চম্পা অবাক হল না, কারণ, বাবা প্রায়ই কাঁদেন, রোজই কাঁদেন, একটা কিছু হলেই কাঁদেন–যা কেউ আশাও করবে না, বিশ্বাসও করবে না। প্রথম যেদিন বাবাকে কাঁদতে দেখেছিল, অবাক হয়েছিল চম্পা। সে তখন বছর নয়েকের। মা–কে তো সারাক্ষণ বকে বকে মাথা খারাপ করে রাখতেন বাবা; সেদিন চম্পা কোথায় বেড়াতে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখে বাবার ম্যাজিক দেখাবার রঙিন লাঠিটা মা আমার সতীন, আমার সতীন বলতে বলতে বটি দিয়ে দুখানা করছেন, আর পশ্চয!–বাবা বারান্দায় বসে নিঃশব্দে কাঁদছেন। সে বছরই বাবা তার নিজের দল করেছিলেন। চৌদ্দ বছর বয়সে চম্পা এসে দলের একজন। হল। সেই থেকে আজ প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে। বাবা যখন স্টেজে গিয়ে দাঁড়ান, চোখ বাঁধা অবস্থায় কালো বোর্ডে অঙ্ক কষে ফেলেন, চম্পা যখন স্টেজে আসে, সবাইকে ঝুঁকে সালাম করে দুটো টুলের ওপর রাখা বাসের মধ্যে গিয়ে সেঁধোয় আর তার বাবা আর জহির করাত নিয়ে দুপাশে দাঁড়ায় তাকে জীবন্ত দুখণ্ড করবার জন্যে; টুপির ভেতর থেকে নাবা যখন পাঁচটা পায়রা বের করে উড়িয়ে দেন আর ওরা চা কারে হলের মধ্যে ঘুরতে থাকে, অচেনা অন্ধকার দেখে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আবার ফিরে আসে বাবার হাতেই, তখন প্রচণ্ড হাততালিতে হল ফেটে না পড়লে বাবার ভারি কষ্ট হয়। শশা ভাঙলে কোট পান্ট শুদু বিছানায় এসে শুয়ে পড়েন, মিথ্যে করে বলেন, জ্বর এসেছে। চম্পা জানে, বাবা তখন কাঁদছেন। চম্পা বোঝাতে চেষ্টা করে ঠাণ্ডা পড়েছে, আলোয়ানের ভেতর থেকে সবাই হাত বের করতে চায়নি, তালিটা তাই ফিকে হয়েছিল; কিংবা গায়ের লোক তো!–ব্যাপার দেখে চক্ষু চড়কগাছ, হাততালি দেবে কী! কিন্তু বাবা তা শুনবেন না। কাঁদবেন। এমনকি টিকেট কতো বিক্রি হল, তাও আব সেদিন খোঁজ নেবেন না; সেদিন জহির আর সামাদ ক্যাশবাক্স থেকে কম করে হলেও দুখানা দশ টাকার নোট সরাবে। চম্পা ও নিয়ে হৈচৈ করতে পারে না, বাবা শুনলে তাদের কিছু তো বলবেনই না, আবার দুহাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে নতুন করে কাঁদতে বসবেন।