- বইয়ের নামঃ বালিকার চন্দ্রযান
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- প্রকাশনাঃ প্রথমা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. শনি আর রোববার ছুটির দিন
শনি আর রোববার ছুটির দিন হলেও মিস্টার আলির ছুটি নেই। তাঁকে কাজ করতে হয়। শনিবার দিন তো শাপলা ট্রাভেল এজেন্সি তাঁকে খোলা রাখতেই হয়, রোববারে বেরুতে হয় লন্ডনের বাইরে খদ্দের পটাতে, নতুন খদ্দেরের জন্যে জাল ফেলতে। ম্যানচেস্টারে। বার্মিংহামে, কার্ডিফে। এসব জায়গায় বাঙালি আছে, ভারতীয় আছে, আছে পাকিস্তানি। তবে মিস্টার আলি পাকিস্তানি পাড়ায় আর পা বাড়ান না; অথচ একাত্তর সালের জুন মাস পর্যন্ত লন্ডনে তিনি পি.আই.এ-তে চাকরি করা কালে বিস্তর পাকিস্তানির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। বিলেতে এখন পাকিস্তানিরা বাঙালিকে ব্যবসা দেয় না। অথচ, মিস্টার আলি ক্রোধ অনুভব না করে পারেন না, বাঙালিরা দিব্যি ব্যবসা দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানিদের। তাঁর এই ক্রোধ দেশাত্মবোধক হবে বলে মনে হতে পারে কইরে থেকে। অনেক বাঙালি খদ্দের তার কাছে কিন্তু আসে তিনি বাঙালি বলে। তারা বলে, এক পাকিস্তানির কাছে কিছু সামান্য দর পেয়েছিলাম, কিন্তু আপনার কাছেই এলাম, পয়সা যদি দিতে হয় তো বাঙালিকেই দেব। অথচ তারা জানে না, মিস্টার আলিকে খদ্দেরের মাল প্যাকিংয়ের জন্যে অন্তত পাকিস্তানি মিস্টার খানের কাছে যেতে হয়। এই তথ্যটি তিনি সযত্নে গোপন রাখেন এবং খদ্দেরকে বলেন তাঁর নিজস্ব ওয়ের হাউস আছে, প্যাকার আছে। গতকাল এক বাঙালির হাজার তিনেক পাউন্ডের ব্যবসা অল্পের জন্যে তিনি পান নি। পেয়েছে মিস্টার খান। দেশমুখো বাঙালিটি যতরকম বিজলীর জিনিস বাজারে, প্রায় সবই। নিয়ে যাচ্ছেন। কয়েকবার মিস্টার আলির কাছে এসেছেন, তালিকা করেছেন, এক রকম কথাও দিয়েছেন তার কাছ থেকেই কিনবেন। শেষ পর্যন্ত কিনলেন তিনি মিস্টার খানের কাছ থেকে। আলিকে যেতে হয়েছিল খানের কাছে একটা কাজে, আর সেখানে গিয়ে দেখেন বাঙালিটা সওদা করছে। এমন নির্লজ্জ, লোকটি অপ্রস্তুত হয় নি। অবশ্য, সেটাও ভেবে। দেখেছেন আলি, বিলেতে কষ্ট করে এক কামরায় রান্না-থাকা-খাওয়া করে জমিয়ে জিনিস কেনার সময় যেখানে সুবিধে, এক পয়সা সুবিধে হলেও সেখানে কিনবে বৈকি। বাংলাদেশে বাপের দৌলতেও যা কেনার মুরোদ হয় না বহু বড়ে খাঁর এখানে ইংরেজের মতো কামিয়ে আর বাঙালির মতো বাস করে, হেজিপেজিও ফ্রিজ টেলিভিশন রিকনডিশন্ড গাড়ি কিনে ফেলে। গরীবের জুতো হলে যা হয়, ঘুমোবার সময় পর্যন্ত জুতো বালিশের পাশে নিয়ে শোয়। চক্ষুলজ্জা থাকবে কেন?
তবু মনটা খিচড়ে ছিল আলির।
বসত বাড়িরই নিচের তলায় সমুখের ঘরে তার কোম্পানির আপিস–শাপলা ট্র্যাভেলস এজেন্সি। কিম্বা বলা যায়, দোকানের ওপর তলায় তার বাসা।
সকাল নটায় সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, স্ত্রী কামরুন্নাহার পেছন ডাকে।
এই শোন।
আলি বিরক্ত হন। পেছন ডাক মোটেই তিনি পছন্দ করেন না। তাও দিনের শুরু ভোর বেলায় খোদার নাম নিয়ে আপিস খোলার সময়।
মনটা আরো খিচড়ে গেল তার। পেছন ডাকার দোষ কাটাতে তিনি আবার ফিরে এলেন ঘরে।
কী হলো?
না, জিগ্যেস করছি, তুমি আবার বাইরে টাইরে যাচ্ছ না তো?
যাবার থাকলে তো বলেই যেতাম।
বলেই তিনি যান সব সময়। কারণ, তিনি যখন বাইরে থাকেন, কামরুন্নাহারকে আপিসে বসতে হয়। স্বামীর কাজ সে ভালো গোছাতে পারে না, তবে ফোন ধরা, খদ্দের এলে। প্রাথমিক আলাপ করা, লেনদেনের ব্যাপার থাকলে চেক নেয়া, রশিদ দেয়া, এ সব চালিয়ে নিতে পারে।
নাহার হেসে বলে, তোমাকে ডেকেছি একটা কারণে। একবার নিচে নামলে তো আর বাথরুমের দরকার ছাড়া দুটোর আগে ওপরে উঠবে না। বলছিলাম, কাজে যাবার আগে মিনার সঙ্গে একটু কথা বলে যাও।
মিনা, ইয়াসমিন, ওদের বড় মেয়ে।
এক্ষুণি বলার কী আছে?
আলি ঠিক বুঝতে পারেন না, বিয়ের প্রস্তাবই হয় নি এখন পর্যন্ত, এর মধ্যে মেয়ের সঙ্গে কথা কীসের? আজ একজন আসছে ইয়াসমিনকে দেখতে। আনুষ্ঠানিক দেখা নয়, তবু বাড়ির সবাই জানে, পছন্দ করতেই আসছে।
তোমার মেয়ে যদি বিগড়ে বসে?
কেন? বিগড়াবে কেন? বয়স কম হয় নি। বিয়ে বসতে হবে না? নাকি, সে তোমাকে কিছু বলেছে?
এখনো বলে নি, তবে, সন্দেহ করি, বলবে। তোমার মেয়ে তো মেম সায়েব।
ভ্রু কুঞ্চিত করে রাখে আলি।
নাহার বলে, তুমি একটু বসো, মেয়েকে ডেকে দি। তুমি নিজে বলে দাও, শনিবার দেখে যেন আবার বেরোয় না। কাল রাতে পার্টি করেছে। আজ বাড়িতে থাক। একটু রেস্ট না নিলে চেহারাই বা কী দেখাবে? আর ডাক্তার যখন আসবে, তার সঙ্গে যেন একটু ভালো করে কথাটা কয়।
স্কটল্যান্ড থেকে ইয়াসমিনকে দেখতে আসছে ডাঃ ভাইয়ান। মানে, ডাঃ ইউনুস ভূঁইয়া। ইংরেজের মুখে ‘ভূঁইয়া হয়েছে ‘ভাইয়ান। এখন সেটা নামের খোদ মালিক নিজেই ব্যবহার করে।
তোমার কি মনে হয়, মিনা গোলমাল করবে?
স্ত্রীর কথায় আলি সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েন। মেম সাহেব হয়ে যাবার উল্লেখটাও তাকে চিন্তিত করে তোলে। মুখের ওপর ছেলেটিকে না বলে দেবে নাকি? রীতিমতো শংকিত হয়ে পড়েন আলি। যদুর যা শুনেছেন ডাঃ ভাইয়ানকে তার পছন্দ হয়েছে, শুধু চোখে দেখতে বাকি। আর ডাক্তার পাত্র, কম লোভনীয় নয়।