- বইয়ের নামঃ নিষিদ্ধ লোবান
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. নবগ্রাম
নবগ্রামে ট্রেন এসে যায়। আর এক ইস্টিশান পরেই জলেশ্বরী, এ লাইনের শেষ। বিলকিস যাবে জলেশ্বরীতে। ঢাকা থেকে তোরসা জংশনে এসেছে বেলা এগারোটায়। তারপর তিনটেয় পাওয়া গেছে। জলেশ্বরীর গাড়ি। সাধারণত সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যায়। কিন্তু এখন কোনো কিছুই নিয়মিত নয়। কেউ তা আশাও করে না।
এমনিতেই তোরসা থেকে জলেশ্বরী অবধি ট্রেন চলে খুব ধীর গতিতে। ছেলেবেলায় বাবার কাছে বিলকিস। শুনেছিল, এই লাইনটি আসলে পুরনো ডিস্টিক বোর্ড সড়কের ওপর পাতা রয়েছে। তাই বাক বেশি, মাটিও পাকা নয়, ট্রেন চলে ধীর গতিতে। নইলে উল্টে পড়ে যাবে।
তবুও তোরসা থেকে জলেশ্বরী এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায়। নবগ্রাম আসতে আজ দুঘণ্টা কাবার হয়ে যায়।
ট্রেনে ওঠার পর থেকেই যাত্রীদের ভেতরে কেমন একটা ফিস-ফ্যাশ সে শুনে আসছিল অনেকক্ষণ ধরে। শহুরে এক মহিলার উপস্থিতিতে মানুষগুলো বড় একটা সপ্রতিভ ছিল না। তাছাড়া সময়টাই এমন যে, মানুষ নিচুকণ্ঠ ছাড়া কথা বলে না, অপরিচিত দূরে থাক, পরিচিতকেও বিশ্বাস করে না।
বরাবর দেখে এসেছে বিলকিস, নবগ্রামে ট্রেন দুই মিনিটের বেশি থামে না।
নির্ধারিত সেই দুমিনিট পেরিয়ে যায়। অধিকাংশ যাত্রী ট্রেন থামবার সঙ্গে সঙ্গে নিঃশব্দে দ্রুতগতিতে নেমে পড়ে। ইস্টিশানের বাইরে ঘন বুনো ঝোঁপের ভেতর সরু পথ দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে তারা কে কোথায় মিলিয়ে যায়। আর যারা বসে থাকে, যাদের গন্তব্য জলেশ্বরী, তারা দুমিনিট পরেও যখন ট্রেন ছাড়ে না, ঢিল খাওয়া অবোধ পশুর মতো তারাও কামরা ছেড়ে অন্তর্হিত হয়ে যায়।
মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যায়। সারা ট্রেন।
জানোলা দিয়ে একবার বাইরে তাকায় বিলকিস। কিছু বোঝা যায় না। ট্রেনের পুরনো ইনজিনটার বাষ্পীয় শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না।
হাত ঘড়িতে বিকেল এখন পাঁচটা দশ।
বিলকিস নামে। তার সঙ্গে তার ছোট একটা সুটকেস। এ সময় কুলির ওপর নির্ভরতা কমাবার জন্যেই সে ঢাকা থেকে বহনযোগ্য সুটকেসের বেশি আনে নি। সুটকেসটা নিয়েই সে নামে।
গার্ডকে দেখা যায়। সে খুব দ্রুত পায়ে ইস্টিশান ঘরের দিকে যাচ্ছিল। বিলকিস তাকে ধরে। আমি জলেশ্বরী যাব।
গার্ড তার মুখের দিকে খানিকক্ষণ। হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে থাকে। যেন জলেশ্বরীর নাম সে এই প্রথম শুনেছে অথবা উজ্জ্বল রোদের ভেতরে নবগ্রামের মতো ঘোর পল্লীর ইস্টিশানে, বিলকিসের মতো চটপটে মহিলাকে দেখে গার্ড নিশ্চিত হতে পারছে না। দৃষ্টির বিভ্রম কিনা! এ এমন একটা সময় যখন যা কিছু সম্ভব অথচ মানুষ তার মৌলিক বিস্ময়বোধ থেকেও মুক্তি পায় নি।
বিলকিস ব্যাকুল হয়ে আবার বলে, গাড়ি তো জলেশ্বরী পর্যন্ত যাবে!
আরো কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে গার্ড। লাল নীল নিশান দুটিকে সে অনাবশ্যকভাবে হাত বদল করে নেয়। তারপর কোনো উত্তর না দিয়ে অথবা একটা কিছু দেয়, বোঝা যায় না, শোনা যায় না, সে ইস্টিশানে খড় ছাওয়া নিচু চালার ভেতর ঢুকে যায়। আর কাকে জিগ্যেস করবে। খুঁজে পায় না বিলকিস।
এখন সে কী করে?
ঢাকা থেকে জলেশ্বরী, কতবার যাতায়াত করেছে সেই ছেলেবেলা থেকে। কতবার সে নবগ্রামের ওপর দিয়ে এসেছে, গেছে। কিন্তু কখনো নামা হয় নি। ইস্টশানের ঝোঁপের ওপারও দেখা হয় নি।
এখানে করা থাকে? কিছুক্ষণের জন্যে অচেনা এবং অপহৃত বোধ করে সে।
তাঙ্গু চোখে পড়ে ইস্টশনের ঠিক বাইরে মাটির চাকি বুসানো কুয়োর পেছনে একটি ছেলে। সতেরো আঠারো বছর বয়স। বিলকিসের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই ছেলেটি চোখ ফিরিয়ে নেয়। মুহূর্তে সে ঝোঁপের আড়ালে কোথায় চলে যায়।
হয়তো একে কিছু জিগ্যেস করা যেত, ট্রেনের বিষয়ে কিছু জানা যেত না সত্যি, কারণ ছেলেটি দৃশ্যতই ইস্টশানের কেউ নয়, অন্তত একটি মানুষ পাওয়া যেত। সারা প্ল্যাটফরমে একটি প্ৰাণীও এখন নেই, বিলকিসের মনে হয় চারদিকের এই অচেনা গাছ এবং ঝোপগুলো দুৰ্বোধ্য কী একটা ষড়যন্ত্রে অবিরাম সরসর ফিসফিস করে চলেছে।
ইস্টিশান ঘরের ভেতর ঢোকে বিলকিস।
তাকে দেখেই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে টেবিলের ওপারের লোকটি। নিশ্চয়ই ইস্টশান মাস্টার। গার্ডকে দেখা যায় দুহাতের ভেতর মাথা রেখে টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে বসে থাকতে। সেও এখন তাকায়, দ্বিতীয়বার তাকে দেখা যায় বিহবল চোখে তাকাতে।
আমি জলেশ্বরী যাব। ইস্টিশান মাস্টার তার দিকে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। কোথা থেকে আসছেন?
ঢাকা থেকে।
ওদিকে গাড়ি চলেছে?
হাঁ চলছে। আমি তো এলাম।
ইস্টিশান মাস্টার দৃষ্টি ফিরিয়ে গার্ডের দিকে তাকান। ঠিক তখন ইনজিন ড্রাইভার এসে হাজির হয়।
খবর কী মাস্টার সাহেব?
আর খবর! এখন তোরসায় ফিরে যান। ট্রেন আর যাবে না।
ড্রাইভার গজগজ করে ওঠে। আগে থেকে বললে হতো। তোরসার মাস্টার সাহেব কিছু বললেন না। ইনজিন ব্যাক করে চলে আসতাম, সোজা বেরিয়ে যেতাম এখন।
গার্ড রুষ্ট হয়ে ওঠে। এখন ব্যাক করে যেতে অসুবিধা কোথায়?
আবার সেই তোরসায় গিয়ে ইনজিন ঘুরিয়ে, তিন মাইল চক্কর দিয়ে যে রাখতে হবে, সে আপনি রাখবেন, কি আমি রাখব? তোরসার খবর রাখেন? যে-কোনোদিন যে-কোনো সময়ে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে।
এতক্ষণ উদ্বিগ্ন হয়ে কথাগুলো বিলকিস শুনছিল। শুনে না বোঝার কিছু নেই, তবু তার মনে হচ্ছিল। আরো খানিকটা না শুনলে সে ঠিক বুঝতে পারবে না প্রসঙ্গটা। এবার সে বলে, ট্রেন এখন জলেশ্বরী যাবে না?