চাচারা অনেক করেছেন। এম.এ. পরীক্ষায় যখন থার্ড ক্লাস পেলাম, বকলেন তারা। কী যে দুর্বুদ্ধি হয়েছিল, সিএসপি–র জন্য পরীক্ষা দিলাম। চাচারা খুব খুশি হলেন। বললেন, গ্যাদা হাকিম হলি পর বংশের একটা নাম থাকে। আল্লার উপর ঈমান রাখলি সব হয়। চাচারা আমাকে গ্যাদা গ্যাদা বলেই ডাকেন। আমার নাম যে মুশতাক সেটা মনে হয় ওঁরা জানেনও না। সিএসপি পরীক্ষাতে কিছু হলো না। রিটেনেই ফেল করলাম। চাচারা বললেন, আর পড়াতে পারবেন না। না বললেও আমি নিজেই আর ভার হয়ে থাকতাম না। তখন কিছু দিন বিরাট এক শূন্যতার ভেতর দিয়ে আমার জীবন কাটলো। চার বছর।
এই চারটে বছরের কোন স্মৃতিই আমার নেই। যেন এই চার বছররের এক হাজার চারশো ষাট দিন একরকম। সেই সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, জুবিলি স্কুলে ইতিহাস পড়ানো সেভেন আর এইট ক্লাশে, তারপর বিকেল থেকে নিয়ে রাত এগারটা অবধি ফরাসগঞ্জে গোবিন্দর সরু তেল কালিতে আচ্ছন্ন, কয়লার ধোঁয়ায় হাঁসফাস রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা দেয়া। শেষদিকে তো রেস্তোরাঁর পেছনে কয়লা আর কাঠ রাখবার শেডে বসে ফ্লাস খেলতে শুরু করেছিলাম। একট; পায়া–ভাঙা নড়বড়ে টেবিল ছিল, দুদিকে দুটো বেঞ্চ আর আধখানা, মানে পিঠ–ভাঙা, টিনের চেয়ার। রোজ সন্ধ্যেয় সেখানে ফ্লাস বসতো। কোনদিন হারতাম, কোনদিন জিততাম। আমার ভাগ্যে চূড়ান্ত কিছু লেখা ছিল না। অনেকে ছিল রোজ হারতো, আবার অনেকে জিতে যেত দিনের পর দিন। দেখতাম, কেবল আমিই আলাদা। গোবিন্দ যখন চপ দেয় তখন সঙ্গে একটা ছোট্ট ভিনিগারের শিশি আসে। সে শিশিটা কেউ খোলে না। বিস্বাদ নাকি। কিন্তু টেবিলে নিত্য আসা চাই। আমার অস্তিত্ত্ব ছিল ঐ ভিনিগারের শিশিটার মতো!
তখন নিশাতের সঙ্গে আমার দেখা।
তারপর একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগেও বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হলো না। মনে হলো, আমার সমস্ত শক্তি গতরাতে কে যেন নিঃশেষে বার করে নিয়ে গেছে। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা সুন্দর একটা বাতাস বারে বারে সে আমার মুখ ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে। একবার খুব দাপাদাপি করে বাতাসটা এলো। আর আমার তখন কান্না পেল। আমার এক বন্ধু বিয়ে করেছে, তার সঙ্গে থাকি। বাইরের ঘরটার আব্রু নেই। চাটা আসবে ঘর ঝাট দিতে। কাঁদতে লজ্জা করল আমার। যদি নিজের বাসা থাকতো–বাসা করবার মতো যদি কিছু করতাম আমি।
ছেলেবেলায় পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলে রাতে শুয়ে শুয়ে ঘুম আসত না একেকবার। প্রতিজ্ঞা করতাম, সামনের বছর ফার্স্ট হবই হব, যেমন ওরা সবাই হয়। ঠিক সেই রকম করে উঠল বুকের ভেতরটা। নিশাতকে গিয়ে বললাম, আমি ল পড়ব।
নিশাত একেবারে আকাশ থেকে পড়ার মতো চেহারা বানিয়ে মুখ গোল করে প্রতিধ্বনি করল, ল?
সেই থেকে শুরু হলো আমার নতুন করে চলা। একেবারে সব ভুলতে শুরু করলাম। অতীতের সবকিছু। কী করে, কিছু বলতে পারব না। দেশের কথা আর মনে পড়ে না, চাচাদেরও না। সেই মেজো চাচির কথা, যার সঙ্গে রাতে ঘুমোতাম, তাকেও না। যেন ওসব অন্য কারো জীবনের গল্প। যেন আমি জন্ম থেকে এখানে এমন করে রাতে রাতে ল পড়ছি, কখনো দেখা হচ্ছে নিশাতের সঙ্গে, হাঁটছি স্টেডিয়ামের মোড়ে, আমার বন্ধু-স্ত্রী বাচ্চা হবে বলে হাসপাতালে গেছে– দুবন্ধুতে হাত পুড়িয়ে রান্না করছি, সিনেমার পোস্টারে অতিকায় মুখগুলো থমকে দাঁড়িয়ে দেখছি।
আশ্চর্য, চাচারাও ভুলে গেলেন আমাকে। হাকিম হয়ে বংশের নাম পেটাতে পারলাম না। বোধহয় সেই দুঃখে। কখন যে আমার জীবনের সব কটা নোঙর আস্তে আস্তে খসে পড়ল তার এতটুকু বুঝতে পারিনি। নিঃশব্দে একটা বিরাট পরিবর্তন হয়ে গেল, কেউ জানতে পারল না। তাকিয়ে দেখি, নতুন নোঙর কখন আমি ফেলে বসে আছি; কখন সেই বাঁধনে স্থির হয়ে বড় বড় ঢেউগুলোকে অনায়াসে কাটাতে পারছি; আমার জীবন বড় সুমিত হয়ে গেছে; অনেক কাদা ভোবা খানা খন্দ পেরিয়ে সাজানো গোছানো ছবির মতো বড়
বাড়ির নিরিবিলি বাগানে গিয়ে দাঁড়ালে যেমন হয় তেমনি। নিশাত। ভারী সুন্দর নামটা। ওর চেহারার সঙ্গে, চলনের সঙ্গে, চিবুক তুলে কথা বলবার ধরনটার সঙ্গে নামটার কোথায় যেন মিল আছে। মিলটা যে কী, আর কোথায়, জিগ্যেস করলে তা বলা যাবে না– কেবল অনুভব করা যায়। একেকটা নাম, কী জানি কেন, উচ্চারণ করবার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার মতো কল্পনার ভেতর থেকে একটা মুখ ভেসে উঠতে থাকে। সেই মনে করা মুখটার সঙ্গে কখনো আসল মানুষটার আশ্চর্য মিল থাকে, কখনো থাকে না। নিশাতকে বলেছিলাম। শুনে অবধি ও এমন উচ্চকণ্ঠে হাসতে লাগল।
.
বলছিলাম না, নিশাতের সঙ্গে সেদিন দেখা করতে গিয়েছিলাম। মনটা ছিল অসম্ভব রকমে ভালো। খুনের মামলায় জিতে যাওয়ার দরুণ করকরে টাকাগুলো ছিল পকেটে। অক্টোবরের শীত–শীত দেখে আমার ফিকে সবুজ জাম্পারটা বার করে পরেছিলাম। রুমালটা পকেটে ঢোকাতে গিয়ে দেখি মলিন হয়ে আছে। জিন্নাহ এভেন্যুতে এসে একটা শাদা ফিনফিনে রুমাল ভারী পছন্দ হলো। দাম তিন টাকা বারো আনা। মসৃণ, ইস্ত্রী করা, হাতে রাখলে যেন পিছলে পড়ে যাবে। পকেটে সারাক্ষণ হাত ঢুকিয়ে অনুভব করতে লাগলাম রুমালটার স্পর্শ। নিশাত বোধহয় এতক্ষণ কলেজ থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছে।