- বইয়ের নামঃ জনক ও কালোকফি
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. আমাকে আবার ফিরে আসতে হলো
জনক ও কালোকফি – সৈয়দ শামসুল হক
আমাকে আবার ফিরে আসতে হলো। নিশাতের সঙ্গে আমার কখনো যদি দেখা না হতো তাহলে আসতাম না। নিশাত না হয়ে অন্য কেউ হলে কী হতো জানিনে। নিশাত এতদিন আমার কাছে কাছে, ওকে ছাড়া এই যে আমি আর কিছু ভাবতে পারিনে, এই যে আমার সব কাজ, সব ভবিষ্যতের মধ্যে কেবল নিশাতের মুখ দেখতে পাই– তবু এতদিন এখানে ফিরে আসার কথা মনে আসেনি। আজ আসতে হলো।
মা’র কাছে আমি ছাব্বিশ বছর পরে ফিরে আসছি। নিশাত বলেছে, আমার বউ হতে ওর কোনো আপত্তি নেই।
বউ? আমার বউ? চব্বিশ ঘণ্টা আমার শয়নে জাগরণে তন্দ্রায় কি স্বপ্নে একটা মেয়ে থাকবে। যেখানেই যাই না কেন, ফিরে এলে ঘরে দেখব একটি মুখ, হাসিতে খুশিতে ভরা; খামের মধ্যে উঁকি দেয়া চিঠির মতো উৎসুক একটি মেয়ে। তাকে সকালে দেখব সবুজ পেস্ট ব্রাশে লাগিয়ে দাতে ঘষে ঘষে ফেনা তুলে দাঁত মাজছে; দেখব ভিজে চুলে একাকার হয়ে এক পায়ে স্যাণ্ডেলে গলাতে গলাতে বেরিয়ে আসছে বাথরুম থেকে; দেখব অবেলা দুপুরে ঘুমে লালায় ভিজিয়ে তুলেছে বালিশের কোণ –চকচক করছে ঠোঁট– গালে ভাঁজ পড়েছে লাল ফিতের মতো–মুখ দেখাচ্ছে নতুন তুলোয় তৈরি যেন; দেখব খাটের কোণে পা ঝুলিয়ে হাসতে হাসতে সে খুন হয়ে যাচ্ছে; দেখব রাতের অন্ধকারকে খুব ভয় করে আমার মুখের পরে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিসিয়ে বলছে–এই ওঠো না, আমি একটু বাইরে বেরুবো। বউ? আমার বউ? নিশাত আমার বউ হয়ে আসবে, আসতে পারে যদি আমি তুলে নিই, বলেছে। যেন একটা সরোদ হঠাৎ সোনার কমলের মতো বিরাট এক ফুল তৈরি করতে লাগল আমার বুকের মধ্যে, চোখের পরে, যখন কথাটা শুনলাম। আমরা, আমি আর নিশাত, তখন স্কুটারে মোহাম্মদপুর থেকে শহরের দিকে আসছি। সন্ধ্যেটা কেবল হয়েছে, বাতিগুলো তখনো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে না, ছেলেমেয়েরা তখনো রাস্তায়। আর একটা লাল মেঘ নতুন শালের মতো ঝকঝক করছে পশ্চিম আকাশে।
নিশাত থাকে মোহাম্মদপুরে। ওকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাদের দেখা হতো বড় মজা করে। বড় রাস্তা থেকে সুরকি ঢালা সরু একটা গলি চলে গেছে কাঁঠাল গাছের তলা দিয়ে ডানদিকে, মাঠের সঙ্গে মিশেছে। মাঠ পেরিয়ে বর্ষার পানি ভরা ডোবা। সে ডোবার পাড় দিয়ে ভিজে এঁটেল মাটি পেরিয়ে বাঁদিকে বেড়ায় ঢাকা টিনের ছোট্ট একটা বাড়ি। নিশাতদের। ওর ভাইজান ৫০ সালের রায়টের পর কলকাতা থেকে এসে কিনেছিল। ওর ভাবীর ছোট্ট ছেলে থোকনটাকে সারাদিন চোখে চোখে রাখতে হয়, কখন পানিতে পড়ে; পানির দিকে ওর এত লোভ, ছাড়া পেলেই টলমল করতে করতে ডোবার পানিতে গিয়ে মুখ দেখাবার চেষ্টা করবে। সেবার ওপাশের রায়হানরা দেখেছিল, নইলে ঠিক মরতো। আরেকবার নিশাতের বুকে ঘুমিয়ে পড়েছিল দুপুরে। নিশাতও। কখন যে উঠে গেছে জানে না। ভাবী খুব বকেছিলেন নিশাতকে। কাঁধের ব্যাগটা ঘোরাতে ঘোরাতে নিশাত আমাকে বলেছিল, বাবারে বাবা এত দুষ্টু। আমার নিজের ছেলে হলে মার খেয়ে মানুষ হতো। নিশাতের মুখে নিজের ছেলে শুনে অবধি ধুক করে উঠেছিল আমার ভেতরটা। তখনো নিশাতকে বলিনি, ওকে আমি বিয়ে করতে চাই। মেয়েদের সম্পর্কে গল্প–উপন্যাস–সিনেমা থেকে আর বন্ধুবান্ধবের কাছে মেলারকম শুনে শুনে একত্রিশ বছর বয়স করেছি। শুনেছি, ওরা নাকি বড় চাপা, মুখে কিছু বলবে না, যদি বলে তো আকারে বলবে, ইঙ্গিতে বলবে, নীরব চোখে নাচন তুলে জানাবে, কথায় কখনো না।
খুব স্পষ্ট মনে আছে আমার, সেদিন নিশাতের মুখে নিজের ছেলে কথাটা আমাকে বেশ চঞ্চল করে তুলেছিল। তারপর নিশাত যে সারক্ষণ বকবক করে কী বলেছিল কিসসু আমার মাথায় যাচ্ছিল না। আমার চোখের ভেতরে আমি যে সমস্ত জিনিস ভালোবাসি, যেমন নতুন চাদর, লাল ফুল, সিনেমার বড় বড় পোস্টার, স্টেডিয়ামের মোড়, নিশাত– এই জিনিসগুলো অর্থহীন কারণহীন একটা নাচ করছিল। ঘুরে ঘুরে, একটার গায়ে আরেকটা গড়িয়ে পড়ে আমাকে তন্ময় করে রাখছিল। আর কার যেন সুন্দর গানের মতো একটা তান শুনতে পাচ্ছিলাম। সেই তানের ভেতর থেকে পাড়ের বুনোনের মতো একটা ছলোছলো আবছা হাসি শুধু। আর কিছু না। হঠাৎ চোখ তুলে দেখি বড় রাস্তা থেকে সুরকি ঢালা গলির মুখে কাঁঠাল গাছের নিচে আমি একা দাঁড়িয়ে। আর নিশাত চলে যাচ্ছে। তার পেছনটা শাড়ির ফুলে ফুলে আচ্ছন্ন, একটা অতিকায় ফুলদানির মতো দেখাচ্ছে। তখন মনে পড়ল, একটু আগেই তো নিশাত বলল, আমি যাচ্ছি আর আমি বললাম, আচ্ছা।
যে কথা বলছিলাম। নিশাতের সঙ্গে আমার দেখা হতো বড় মজার। গলিটার মুখে একটা নতুন ওঠা দোতলা বাড়ি, তার সামনের জমিতে টিনের একটা শেভ তুলে দিয়েছে বাড়িওলা। শেডের মধ্যে তিনটে দোকান। একটা লন্ড্রী। একটা মুদিখানা। আর এপাশে চায়ের দোকান। চায়ের ওখানে আমি এসে বসি বাস থেকে নেমে। একা যখন আসি তখন বাসে। নিশাতের সঙ্গে বেরুতে হলে স্কুটার। স্কুটারে চাপতে আমার খুব ভালো লাগে। হেলান দিয়ে বসে, একটা হাত সিটের মাথায় বিছিয়ে, ঝরঝর ভটভট করতে করতে পীচঢালা রাস্তা দিয়ে দালান ইস্কুল পেট্রলপাম্প সায়েন্স ল্যাবরেটরী পেছনে ফেলে নিউ মার্কেটের মোড়ে শোঁ-ও করে বাঁক নিয়ে চলতে আমার ভারী আনন্দ। নিশাতের আগে মাথা ধরে যেতো স্কুটারের ঐ কটকটানিতে। আজকাল কিছু বলে না। মেয়েরা নাকি যাকে ভালোবাসে তার অপছন্দটাকেও পছন্দ করে নেয়। আমার এটা ভালোই লাগে যে নিশাত আমার স্কুটার চাপার আনন্দটাকে নিজের কষ্ট তুচ্ছ করে বড় করে দেখছে। এতে হাতেনাতে একটা প্রমাণ পেয়ে যাওয়ার তৃপ্তি হয় আমার যে নিশাত আমাকে ভালোবাসে।